নাসিরনগরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রচারনায় মন্দির ভাংগা মামলার এজাহারভুক্ত আসামীরা

জাতীয়

ডিসেম্বর ৮, ২০২৩ ৫:৫৫ অপরাহ্ণ

নাসিরনগর( ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ সংসদীয় ২৪৩ নাসিরনগর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য বি এম ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তবে ২০১৬ সালের আলোচিত সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত কয়েকজনকে দেখা গেছে তাঁর মত বিনিময় সভায়। বিষয়টি নিয়ে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও আতঙ্ক ।এলাকার হিন্দুরা বলছেন, হামলার ঘটনায় হওয়া মামলার গ্রেপ্তারী পরোয়ানাভুক্ত আসামি,জামিনে থাকা আসামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন সংসদ সদস্য সংগ্রাম। ওই ব্যক্তিরা নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন। ফলে সুষ্ঠু বিচার নিয়ে সন্দিহান এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা।

মঙ্গলবার উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের এক মতবিনিময় সভা করেন সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. ফারুক মিয়া। ফারুখ নাসিরনগরর সদরের কাশিপাড়া গৌর মন্দিরে হামলার ঘটনায় নির্মল চৌধুরী বাদী মামলার ১০৫ নম্ভর চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। তাছাও কাজল দত্তের করা উপজেলা সদরের দত্তবাড়ির পারিবারিক মন্দিরে হামলার ঘটনার ১১৪ নম্বর আসামিও ফারুক।

একই অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যের সঙ্গে ছিলেন  হামলায় আরেক অভিযুক্ত তৎকালীন চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি। দত্ত বাড়ির পারিবারিক মন্দিরে হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আসামির তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে ৯১ নম্বরে। কাশিপাড়া গৌর মন্দীরে হামলার মামলায় ৭৬ নম্বর আসামিও দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি।

রসরাজ দাস নামের এক জেলের কথিত ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ধর্ম অবমাননা হয়েছে,এমন অভিযোগ তুলে হামলা হয়।২০১৬ সালের ৩০শে অক্টোবরের এ ঘটনায় ১৫টি মন্দির ও তিন শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। এ ঘটনায় আটটি মামলা হয়।এতে আসামির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। যাদের অধিকাংশই আদালত থেকে জামিনে আছেন।

রসরাজের বড় ভাই দয়াময় দাসের বাড়ি ও মন্দিরে হামলা হয়। এ ঘটনায় দয়াময় দাসের করা মামলার চার নম্বর আসামি দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থেকে গ্রেপ্তার হন আঁখি। একই বছর ১২ মে উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের জামিন পান তিনি। ২১ জুন আবারও তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনটি মামলায়ই আতিকুরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল।

অপর আসামি মো. ফারুক মিয়া এসব মামলায় আসামি হয়েও সাত বছর ধরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গত ইউপি নির্বাচনে হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁকে বিভিন্ন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসনের নানা সভা-সমাবেশে দেখা গেছে।

কাশিপাড়া গৌর মন্দিরে হামলার ঘটনায় চার্জশিটভুক্ত ৭৭ নম্বর আসামি সুরুজ আলীকে দেখা গেছে ৩ ডিসেম্বর চাপরতলা বাজারের পাশে এক মতবিনিময় সভায়। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অসীম কুমার পাল ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। একই মঞ্চে বিশেষ অতিথি ছিলেন চাপরতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মন্দির ভাংগা মামলার আসামী সুরুজ আলী। সেখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাফি উদ্দিন,মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রুবিনা আক্তার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লতিফ হোসেনসহ অন্যদের দেখা গেছে।

এসব ঘটনায় ক্ষমতার কাছে নিজেদের পরাজয় দেখছেন উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেবেশ চন্দ্র ভৌমিক। তিনি একই সঙ্গে উপজেলা কৃষক লীগের তথ্যবিষয়ক সম্পাদকের পদেও রয়েছেন। দেবেশ ভৌমিকের কথায়, ‘যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন, তাদের ছত্রছায়ায় যদি মন্দির ভাঙার আসামিরা চলাফেরা করে–তাহলে কিছু বলার নেই। নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় বিচার পাব কিনা–এ নিয়ে আমরা সন্দিহান।’
বিচারে যাদের সহায়তা করার কথা, তারাই আসামিদের নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছেন, সভা-সমাবেশ করছেন–এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে বলেও জানান দেবেশ ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি প্রতিবাদ করি, তাহলে আমাদের ওপর আবারও যে হামলা হবে না এর নিশ্চয়তা নেই।  তাই বিচার পেতে আমাদের শেষ ভরসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’

হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. ফারুক মিয়া বলেন,‘আমি আদালত থেকে জামিন নেইনি। তবে কিছু দিনের মধ্যে আদালতে হাজিরা দেব।’ তাঁর ভাষ্য, ‘কিছুদিন আগে খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ একরামুজ্জামান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মনোনয়নপত্র জমা দেন। সেখানে দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখিও ছিলেন। হঠাৎই এমপি আঁখিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি একান্ত সভায় যোগ দেন। তিনি আমার পাশেই আঁখিকে বসতে দেন।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বি এম ফরহাদ হোসেন সংগ্রামকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে,তিনি বলেন, ‘আমি এ হামলায় অভিযুক্ত আসামিদের নিয়ে নির্বাচনী কাজ করছি–এই প্রশ্ন আমাকে করার আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী একরামুজ্জামান বিভিন্ন মামলার আসামি নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন–সেটা আগে জানুন। তার পর আমাকে প্রশ্ন করুন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ একরামুজ্জামানের বলেন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় চেনা জানা চার-পাঁচজনকে নিয়ে গেছেন। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অসীম কুমার পাল বলেন, এমপির মতবিনিময় সভায়, হামলায় জড়িত যে তিন আসামি অংশ নিয়েছেন, তারা আদালত থেকে জামিনে আছেন। নিজ দলকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী উল্লেখ করে তিনি বলেন, চেষ্টা করব ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলায় জড়িত কোনো আসামি যেন দলের সভা-সমাবেশে আসতে না পারেন।

দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখির মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও বক্তব্য নেওয়া যায়নি। চাপরতলার সভায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলী বলেন, ‘আমি দলের সভাপতি। এমপি আসলে আমি আওয়ামী লীগের যে কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারি। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সোহাগ রানা এসব বিষয়ে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক হামলার মামলায় ফারুক মিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। আমরা তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।’ দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি ও সুরুজ আলী জামিনে আছেন বলেও জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *