দেড় যুগে বাংলাদেশে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্কারী যত ঘূর্ণিঝড়

দেড় যুগে বাংলাদেশে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্কারী যত ঘূর্ণিঝড়

জাতীয় স্পেশাল

মে ১২, ২০২৩ ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এখানে প্রতি দশকেই নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে জনজীবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। আর যারা ভাগ্য জোরে বেঁচে গেছে, সহায় সম্বলটুকু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় খুঁজেছে।

আবারো আগমন ঘটছে নতুন এক ঘূর্ণিঝড়ের। নাম তার মোখা। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড়টি। রোববারের মধ্যেই বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। ধারণা করা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়টি ব্যাপক তাণ্ডবলীলা চালাতে পারে উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে।

তবে জানেন কি? আবহাওয়া অধিদফতর ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করতে শুরু করেছে বেশি দিন হয়নি। বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরসহ ভারত মহাসাগরের উত্তরভাগে যেসব ঘূর্ণিঝড় দেখা দেয়, সেগুলোর নামকরণ করে আইএমডি। এর একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে।

২০০৭ সাল থেকে ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের নামকরণ করা শুরু হয়। প্রথম বাংলাদেশে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের নাম রাখা হয় সিডর। এটি ২০০৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে আঘাত হানে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এতে। তারপর থেকে গত দেড় যুগে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাংলাদেশে। এতে প্রাণহানিসহ মালামালের ব্যাপক ক্ষতিও হয়।

ঘূর্ণিঝড় নামকরণের পর গত দেড় যুগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে জেনে নিন-

সিডর

২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। ১১ নভেম্বর সামান্য দুর্যোগের আভাস পাওয়া যায়। এর পরের দিনই এটি ঘূর্ণিঝড় সিডরে পরিণত হয়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সকাল বেলা পর্যন্ত বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কি.মি এবং ঘণ্টায় ৩০৫ কি.মি বেগে দমকা হাওয়া বইছিল। সন্ধ্যা ৬টার পর বাংলাদেশের পাথরঘাটায় বালেশ্বর নদীর কাছে উপকূল অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড়টি।

শ্রীলংকান শব্দ সিডর থেকে এর নামকরণ করা হয়। যার অর্থ চোখ। ঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলীয় জেলাসমূহে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ঝড়ো হাওয়াসহ বিপুল পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশের প্রায় ছয় লাখ টন ধান নষ্ট হয়। বিপুলসংখ্যক মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণী মারা যায়। প্রায় নয় লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয় সিডরে। প্রায় ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এতে মারা যায় প্রায় দুই লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু ও হাঁস-মুরগি।

নার্গিস

নার্গিস একটি উর্দু শব্দ, যার অর্থ ফুল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি হলো নার্গিস। ২০০৮ সালের মে মাসে এটি মিয়ানমারে আঘাত হানে। এতে প্রাণ হারায় এক লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ। এতে চার লাখ ৫০ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়লেও তেমন বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

আইলা

ঘূর্ণিঝড় আইলা ২০০৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়। এটি জন্ম নেয় ২১ মে ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার (৫৯০ মাইল) দক্ষিণে। ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ২৫ মে তারিখে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে। এর নামকরণ করেন মালদ্বীপের আবহাওয়াবিদরা। আইলা শব্দের অর্থ ডলফিন বা শুশুকজাতীয় জলচর প্রাণী।

এই নামটি ঘূর্ণিঝড়ের জন্য নির্ধারণ করেন জাতিসংঘের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের আবহাওয়াবিদদের সংস্থা ইউএন এস্কেপ-এর বিজ্ঞানীরা। আঘাত হানার সময় এর ব্যাস ছিল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। যা ঘূর্ণিঝড় সিডরের থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি। সিডরের মতোই আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। তবে পরে বাতাসের বেগ ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার হয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি সিডর থেকে তুলনামূলক কম হয়েছে।

মহাসেন

২০১৩ সালের মে মাসের শুরুর দিকে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণাংশে নিম্নচাপজনিত কারণে উৎপত্তি ঘটে মহাসেনের। কার্যত স্থির থাকলেও ১০ মে তারিখে ঘনীভূত অবস্থায় চলে যায়। পরবর্তীতে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে রূপান্তরিত হয়। ১৪ মে এটি উত্তর-পূর্বাংশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কার্যত জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। মহাসেন নামকরণ নিয়ে শ্রীলঙ্কার জাতীয়তাবাদী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে।

তারা দাবি করেন, তৃতীয় শতকের সিংহল রাজার নাম থেকে এ নামকরণ হয়েছে। তিনি এ দ্বীপে সমৃদ্ধি আনয়ন করেছেন। তাই প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক রূপের মাধ্যমে ধারণা করা হয় যে রাজা হয়তো বা রুষ্ট হয়েছেন। তবে সরকারি কর্মকর্তাগণ একে নামবিহীন ঘূর্ণিঝড়রূপে উপস্থাপন করেছেন। এমনকি শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যমে সেটিকে নামহীন ঝড় বলে বর্ণনা করা হয়। পরবর্তীতে রেকর্ডপত্রে ঝড়টির নতুন নাম নির্ধারণ করা হয় ভিয়ারু।

কোমেন

২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে পাঁচ থেকে সাত ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় কোমেন আঘাত হানে। এটি এমন একটি অস্বাভাবিক গ্রীষ্মপ্রধান ঝড় যেটি বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে উৎপন্ন হয়েছিল। এটি বঙ্গোপসাগরের উত্তরে প্রবাহিত হওয়ার আশেপাশের আরো দেশে ক্ষয়ক্ষতি হয়। কোমেনের তাণ্ডবের সময় মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এতে বাংলাদেশে ৪৫ জন এবং  ভারতের দক্ষিণ-পূর্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে ১০৩ জন মানুষ মারা যায়।

রোয়ানু

২০১৬ সালের ২১ মে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে ৪-৫ চার থেকে ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আঘাত হানে। রোয়ানু একটি ছোট ঘূর্ণিঝড়, যা ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতে আংশিক আঘাত হানে। পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দূরে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর উৎপত্তিস্থল। ধারণা করা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দফতর ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্যানেলের তালিকা অনুযায়ী এ ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হয়েছে রোয়ানু। মালদ্বীপ এ নামটি প্রস্তাব করেছিল। রোয়ানু শব্দটিও মালদ্বীপের। এর অর্থ নারিকেলের ছোবড়ার তৈরি দড়ি।

মোরা

২০১৭ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোরা আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে কক্সবাজার উপকূলের শতাধিক বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়। বেশকিছু গাছপালা উপড়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে উত্তাল হয় সাগর। ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার উপকূল ছুঁয়ে চট্টগ্রাম, হাতিয়া ও সন্দ্বীপের দিকে অগ্রসর হয়।

আক্রান্ত জেলাসমূহে হাজার হাজার কাঁচা ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়। কক্সবাজারে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়। টেকনাফের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। জমির ফসল এবং চাষিদের জমাকৃত লবণ নষ্ট হয়ে যায়। দুই নারীসহ তিন জন এবং রাঙামাটিতে দুইজন মারা যায়।

ফণী

ঘূর্ণিঝড় ফণীর নাম দেয় বাংলাদেশ। এর অর্থ সাপ (ফণা আছে যার)। ফণী ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল ভারতীয় মহাসাগরে সুমাত্রার পশ্চিমে গঠিত একটি ক্রান্তীয় নিম্নচাপ থেকে সৃষ্টি হয়। ৩০ এপ্রিল তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে মোট ৮৯ জনের মৃত্যু হয়।ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়, যার বেশিরভাগই হয় উড়িষ্যায়।

বুলবুল 

২০১৯ সালের নভেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের উপকূল ঘেঁষে প্রথম আঘাত হানার পর বুলবুল প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসে। তবে বুলবুলের পূর্ব এবং পশ্চিম দুইদিকেই তিন কোণার মতো অবস্থানে ছিল সুন্দরবন। সুন্দরবনের গাছপালার কারণে বুলবুল বেশ দুর্বল হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের নামকরণ প্রস্তাব করে পাকিস্তান।

আম্ফান

২০২০ সালে ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার বাতাসের গতিবেগ নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে উঠে এসেছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। বঙ্গোপসাগরের পূর্বদিকে সুন্দরবন ঘেঁষে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আছড়ে পড়ে৷ স্থলভাগে উঠে আসার প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাণ্ডব চালাতে চালাতে আমফান বাংলাদেশ উপকূলের দিকে অগ্রসর হয়৷ঘূর্ণিঝড় আমফান বিকাল ৫টার দিকে উপকূলের বাংলাদেশ অংশে পৌঁছায়।

আমফান বাংলাদেশে আঘাত হানার আগেই উপকূলের বিপদজনক এলাকা থেকে প্রায় ২৪ লাখ মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে উপকূলীয় এলাকার স্কুল-কলেজ ভবনও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ঘূর্ণিঝড়ে বেশ ক্ষয়ক্ষতিও হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *