‘টিকটক’ হবে চীনের কূটনৈতিক হাতিয়ার?

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জুলাই ১০, ২০২২ ৮:৩২ পূর্বাহ্ণ

টিকটকের নাম শুনলেই দৃশ্যপটে প্রথমেই ভেসে ওঠে, নাচানাচি ও গানের কিছু ভিডিও। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে টিকটক এক বিশাল বিনোদনের মাধ্যম। সম্প্রতি টিকটকের জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে গেছে ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামকে। টিকটক টেক্কা দিচ্ছে ইউটিউব ও টুইটারের সঙ্গে। তবে পশ্চিমা টেক বিশ্লেষকরা বলছেন টুইটার হচ্ছে ট্রয় যুদ্ধের ‘ট্রোজান হর্স’, যেটিকে ঘরে তোলার পরে পুড়ে গেছে সমগ্র ট্রয়।

সিলিকন ভ্যালিতে টিকটক ইতোমধ্যে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। কিন্তু চীনা প্রতিষ্ঠান টিকটকের এই উম্ফলনকে সাদা চোখে দেখতে নারাজ পশ্চিমা বিশ্ব। টিকটকের মালিকানা চীনের বাইটড্যান্সের কাছে, হেডকোয়াটারও চীনে। তবে চীনকে ঠিক কতটা বিশ্বাস করা যায়, এটিই এখন প্রশ্ন।

‘আপনার কাছে তথ্য ও উপাত্ত আছে, এর মানে আপনার কাছে আছে শাসনের হাতিয়ার।’- এমনটাই বলে থাকেন টেক বিশেষজ্ঞরা। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে মিল রেখেই দাঁড়িয়ে আছে সিলিকন ভ্যালির বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠানগুলো। সাদা চোখে দেখলে টিকটক একটি স্রেফ বিনোদনের মাধ্যম। কিন্তু মার্কিনীরা বলছেন, এটি চকলেটের মতো মিষ্টি বটে, তবে মোটেও এতটা নিরীহ নয়। খুব সহজেই এ অ্যাপের মাধ্যমে পশ্চিমাদের গোপন তথ্য চলে যাবে চীনের হাতে। খেলার ছলে কূটনৈতিক চালে এগিয়ে যাবে চীন। হঠাৎ করে দেখা যাবে ঘরের খবর চলে গেছে শত্রুব্যূহে।

চীনের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্ক সবসময়ই দোদুল্যমান। পান থেকে চুন খসলেই এদের মধ্যে শুরু হয় তিক্ততা। এমন অবস্থায় মার্কিনীদের ব্যক্তিগত তথ্য চীনাদের হাতে সেধে সেধে তুলে দেয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে- সেটিই এখন বিবেচনার বিষয়। হু হু করে বাড়ছে টিকটকের গ্রাহক সংখ্যা। বর্তমানে ১ বিলিয়নেরও বেশি গ্রাহক টিকটক ব্যবহার করছেন। ফেসবুকের থেকে অর্ধেকেরও কম সময়ের মধ্যে টিকটক এই বিপুল সংখ্যক গ্রাহক জোগাড় করেছে। একথা অনস্বীকার্য যে, চীন বেশ ভালোভাবেই জানে কীভাবে মানুষের মানসিকতাকে ব্যবহার করে ব্যবসা করতে হয়। কিন্তু এ কী কেবলই ব্যবসা, নিছক টাকা কামানোর মাধ্যম? নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি? রয়েছে কোনো কূটনৈতিক চাল? এ ব্যাপারে চীনকে বিশ্বাস করা উচিত নাকি অনুচিত এমন দোলাচলে ভুগছে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের বাঘা বাঘা বিশ্লেষক ও কর্তাব্যক্তিরা।

ধারণা করা হচ্ছে চলতি বছরে টিকটকের আয় হবে ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ২০২৪ সালে এই আয় ছাড়িয়ে যাবে ২৩ বিলিয়ন ডলার। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে টিকটকের আয় বেড়ে হবে দ্বিগুণ।

এদিকে শেয়ারবাজারে এসব টেক কোম্পানি দিনের পর দিন নিজেদের জায়গাকে শক্তপোক্ত করে তুলছে। ২০২০ সালে আমেরিকা ফেসবুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল- প্রতিষ্ঠানটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে অনৈতিক কাজ করছে। ব্যক্তিগত তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে নিজেদের ব্যবসা বাড়ানো নতুন কিছু না টেক কোম্পানিগুলোর জন্য। অনৈতিক হলেও দেদারসে তারা এসব কাজ করে বেড়াচ্ছে। সম্প্রতি ফেসবুক জানিয়েছে গ্রাহক পাওয়ার ক্ষেত্রে ও ব্যবসা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তারা টিকটকের পথ অনুসরণ করবে। এতকাল পশ্চিমারা চীনকে ‘কপি ক্যাট’ (নকলবাজ) বলে আসলেও, এবার খেলা চলে গেছে চীনের মাঠে, বদলে গেছে চিত্র।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টিকটক কিনে নেয়ার পায়তারা করলেও, চীনা কোম্পানিটি এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। বর্তমানে টিকটক তার মূলধন দ্বিগুণ করেছে, গ্রাহক বাড়িয়েছে কয়েকগুণ- এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পশ্চিমাদের সঙ্গে চীনের তিক্ততা। টিকটক এখন কেবল নাচানাচির সাইট নয়, অনেকেই এটিকে নিউজ সাইট হিসেবেও ব্যবহার করছেন। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে টিকটক হয়ে উঠেছে মধ্যমানের এক নিউজ সাইট। টিকটকের অলগারিদম সিস্টেম বেইজিং এর হাতে হওয়ায়, সহজেই এই মাধ্যমটিকে কাজে লাগিয়ে চীনা সরকার তাদের মনমতো খবর প্রচার করতে পারে বলে শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোকে দায়ী করা, করোনাভাইরাসের ব্যাপারে একচেটিয়াভাবে চীনকে সমর্থন করা- টিকটকের ব্যাপারে পশ্চিমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে।

টিকটককে নিরাপদ করতে ইতোমধ্যে পশ্চিমারা প্রতিষ্ঠানটিতে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন। পশ্চিমা কোম্পানি ওরাকলের সঙ্গে টিকটক একত্রে ডাটা অলগারিদম নিয়ে কাজ করছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আসল সময়ে নিজের সুবিধার জন্য চীন টিকটকের গোপন কোডগুলোকে ডিকোডে যতটুকু বাধাপ্রদান করা যায়, তার সবটাই করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই ‘ট্রোজান হর্স’ নিয়ে। পশ্চিমা পড়েছে শাঁখের করাতে। না পারছে টিকটককে ঘরে তুলছে, না পারছে ছুঁড়ে ফেলতে।

সূত্র: ইকোনোমিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *