জুলাই ১৮, ২০২২ ১০:২২ পূর্বাহ্ণ
খুরভালেতি জর্জিয়ান একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম। ইউক্রেন-রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত রুশ বাহিনীর কার্যকলাপের দরুন এই গ্রাম ধীরে ধীরে ছুটে যাচ্ছে স্থানীয়দের দখল থেকে।
বিশাল অজগর যেমন শিকার খেতে চার দিক থেকে পেঁচিয়ে ধরে-গ্রামটিকে সেভাবেই পেঁচিয়ে এনেছে রুশরা। এবার গিলে খাবার পালা।
স্থানীয় বাসিন্দা গিয়া বাটোনিসাশভিলি (৬৩) যখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক শুনতে পান, তখন বুঝতে পারেন রাশিয়ান সেনারা তার বাড়ির পেছনের বাগানে টহল দিচ্ছে।
কারণ, ওদের সঙ্গেই থাকে কুকুরগুলো। তিন বছর আগে রুশ বাহিনী তার বাড়ির পেছনে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দখলে নিয়েছে।
রুশ সেনাদের আক্রোশের শিকার হওয়ার ভয়ে ওই বাগানে ঢোকা তো দূরের কথা, টুঁ-শব্দটি করছেন না। ক্ষয়ে যাওয়া বাড়িটিতে ৮১ বছর বয়স্ক মা নোরাকে নিয়ে থাকেন গিয়া।
রাশিয়ার সীমান্তবর্তী মস্কো-সমর্থিত জর্জিয়ার বিচ্ছিন্ন রাজ্য দক্ষিণ ওসেটিয়ায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং দুই কিলোমিটার চওড়া খুরভালেতি গ্রামটি দেখতে একটি উপদ্বীপের মতো। জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসি উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে একটি উপত্যকায় মনোরম দৃশ্যের হাতছানি দেয় খুরভালেতি।
গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় বসে কিংবা জানালার ফাঁক গলে দেখা যায় দূরের পাহাড়-পর্বতের অসাধারণ কাব্যময় দৃশ্য। আর ওখানেই টহল দিচ্ছে রাশিয়ান সেনারা।
প্রায় ১৬০ পরিবারের এ গ্রামের মানুষগুলো বেঁচে আছেন সীমিত কিছু পেশার ওপর ভিত্তি করে। কেউ মিস্ত্রি, দিনমজুর কিংবা কৃষক। গ্রামে কয়েকজন শিক্ষক রয়েছেন-যারা কৃষিকাজের সঙ্গেও জড়িত।
গিয়া এবং তার মা নোরার আয় বলতে ওই সরকারি পেনশনই। মাসে পান ৩৬০ লরি (১১ হাজার ২৫০ টাকা)। স্থানীয় বাজারমূল্যের তুলনায় এ দিয়ে তাদের দু’জনের পেট চালানো খুবই কষ্টকর। গিয়া বলেন, ‘ফুটো হওয়া ছাদ মেরামতের কোনো উপায় নেই আমাদের। পেনশন দিয়ে আমরা শুধু ওষুধ কিনি।
আরা বাগানে প্রবেশাধিকার তো অনেক আগেই হারিয়েছি। শুধু সবজি চাষের জন্য উঠোনের এক চিলতে জায়গাই অবশিষ্ট আছে। সব মিলে খাবার জোগাড় করতে আমাদের ত্রাহি অবস্থা।’
২০০৮ সালের পাঁচ দিনের যুদ্ধের পর গ্রাম অঞ্চলটি নজরে নিয়েছে রাশিয়ান বাহিনী। তখন থেকেই তারা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া এগিয়ে আনছে একটু একটু করে। গিয়ার মতো ভুক্তভোগীর অভাব নেই। বদ্রি আদিকাশভিলি বলেন, ‘২০০৮ সাল থেকেই আমাদের আর কবরস্থান বা চারণভূমিতে প্রবেশাধিকার হারিয়েছি।
আমাদের মতো অনেক বাসিন্দাই তাদের কৃষিজমির অংশ হারিয়েছেন।’ জর্জিয়ার ন্যায়পালের পরিসংখ্যান অনুসারে সীমান্ত চিহ্নিতকরণের অজুহাতে খুরভালেতি থেকে ৩৬ হেক্টর কৃষিজমি ও চারণভূমি নিয়ে গেছে রাশিয়া।
২০০৮ সালের আগস্টের শেষের দিকে, জর্জিয়ায় রাশিয়ার আক্রমণ এবং প্রায় ৮৫০ জন লোক নিহত হওয়ার পর, মস্কো একতরফাভাবে আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওসেটিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সত্তা যথাক্রমে দেশের পশ্চিম ও কেন্দ্র পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
পরের বছর, দক্ষিণ ওসেটিয়া এবং আবখাজিয়া রাশিয়ার কাছে তাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা দাবি করে। তার পর থেকে কয়েক হাজার সৈন্য এবং রাশিয়ান ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস বর্ডার গার্ড ওই এলাকায় ৩০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। সেগুলোর মধ্যে দুটি রয়েছে খুরভালেতি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে।
জর্জিয়ান কর্তৃপক্ষ কদাচিৎ বর্ডারাইজেশন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলে। জর্জিয়ান ড্রিম ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ওলেসিয়া
ভার্তানিয়ান এ ভূমিকাকে ‘কৌশলগত ধৈর্য’ হিসাবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে রাশিয়ানরা বেড়া তৈরি করছে, কিন্তু আপনি কিছু বলছেন না। কারণ আপনি জানেন আপনি বিরোধিতা শুরু করলে কিংবা খোলামেলা সংঘর্ষে জড়ালে আপনার দেশের খোলনলচে পালটে যেতে পারে।’
এই দখলের প্রতিবাদে মুখ খুলেছিলেন খুরভালেতির একজন স্পষ্টভাষী বাসিন্দা ডাটা ভ্যানিশভিলি। ২০২১ সালে ৮৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ২০১১ সালে তার বেড়ার অধীনে নেওয়া হলে তিনি বাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেছিলেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বাড়িটি গ্রামের অন্যান্য বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ঠেকাতে পারেননি। ৩৩ বছর বয়সি মালখাজ ভ্যানিশভিলি বলেন, ‘রাশিয়ান সৈন্যরা এলোমেলোভাবে আমাদের বাড়িতে আসত, দরজা খুলবে আর বেজমেন্ট পরীক্ষা করবে। আমার দাদা তাদের শুধু অভিশাপ দিতেন, আমরা দাদাকে শান্ত করার চেষ্টা করতাম।’
মালখাজ স্বাস্থ্যসমস্যার কারণে কোনো কাজ করতে পারে না। তার একমাত্র আয় মাসিক সামাজিক কল্যাণ ভাতা ২০০ লরি (ছয় হাজার ৩৮০ টাকা)।
দুঃখজনক হলো, মালখাজ তার বাবার বাড়িতে যেতে পারছেন না। কারণ রাশিয়ান সেনারা তাদের বিচ্ছিন্ন করার সময় বাবার বাড়ি ওপারে খুরভালেতির অংশে পড়ে যায়। মালখাজ বলেন, ‘মাসে একবার বা দু’বার আমাদের দেখা হয় কাঁটাতারের কাছে।