চীনে ক্ষমতা কী শক্তিশালী করছেন শি জিনপিং?

চীনে ক্ষমতা কী শক্তিশালী করছেন শি জিনপিং?

আন্তর্জাতিক

অক্টোবর ১৭, ২০২২ ১২:০৫ অপরাহ্ণ

চীনের রাজনীতির ক্যালেন্ডারের মধ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সম্মেলন। এরই মধ্যে রোববার বেজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে দুই হাজার ৩০০ প্রতিনিধি নিয়ে শুরু হয়েছে সেই সম্মেলনের কার্যক্রম। এ সম্মেলনে পাঁচ বছরের জন্য সিসিপির শীর্ষ নেতৃত্ব, সংবিধান সংশোধন ও চীনের নীতি অনুমোদিত হবে।

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর সিসিপির ২০তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ সম্মেলন চীনের দুই বারের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্মেলনে সিসিপির শীর্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বোর্ডগুলো, সংগঠনটির রাজনৈতিক নির্বাহী সিদ্ধান্ত (পলিটব্যুরো) এবং অভিজাত রাজনৈতিক নির্বাহী বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্তসহ তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতায় থাকতে পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল হতে চাইছেন শি জিনপিং।

কেন সিসিপির সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ?

সিসিপির নেতৃত্বে চীনের এক দলীয় শাসন নীতির পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হন সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল। শি জিনপিং ২০১২ সালে সিসিপির সেক্রেটারি জেনারেল পদ নেয়ার পর দুইবার পূর্ণ পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। যদি সম্মেলনের নিয়ম অনুযায়ী চলে, তবে তিনি নতুন কাউকে জেনারেল সেক্রেটারির পদ হস্তান্তর করবেন। এতে নতুন প্রেসিডেন্ট পাওয়ার পথে থাকতো চীন। কিন্তু ৬৯ বছরের শি জিনপিং আরো পাঁচ বছর সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারি ও প্রেসিডেন্ট থাকার প্রত্যাশা করছেন।

শি জিনপিংয়ের দুই পূর্বসূরি হু জিনতাও এবং জিয়াং জেমিন দুইবার পাঁচ বছর পূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে পদ ছেড়ে দেন। তবে তিনি সেই নিয়ম ভাঙলে তৃতীয়বারের মতো সিসিপির শীর্ষ পদ ও প্রেসিডেন্ট পদ আঁকড়ে ধরবেন।

সিসিপির সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়াও আরো দুটি দায়িত্বে রয়েছেন শি জিনপিং। তিনি সিসিপির কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান এবং দ্যা পিপলস রিপাপলিকান অব চায়নার সভাপতি। সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান পদটি শি জিনপিংকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়েছে এবং দ্বিতীয়টি তাকে চীনের প্রধান বানিয়েছে। শি তার সামরিক পদ এবং আগামী মার্চে অনুষ্ঠিতব্য চীনের দ্য ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে রাষ্ট্রের প্রধান পদ ধরে রাখতে চাইছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) চায়না পাওয়ার প্রজেক্টের ফেলো ব্রেইন হার্ট বলেন, ২০তম সিসিপির সম্মেলনে পার্টি, রাষ্ট্র ও সামরিক পদে শি জিনপিং আঁকড়ে ধরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

হার্ট বলেন, তৃতীয়বারের মতো সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারি পদে আসীনের পর শি শীর্ষ পদের বাছাইয়ের জন্য একটি শক্তিশালী স্থান পাবেন। প্রথম দুইবার সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারি পদে থাকার সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য মিত্রদের রাজি করিয়েছেন। এতে গোপনে অনুষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তিনি একচ্ছত্র অধিকারী হবেন। পূর্বসূরিদের মতো শি তার কোনো উত্তরসূরির সঙ্গে স্পষ্টভাবে প্রতিযোগিতা করছেন না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার বোর্ডে প্রভাব বিস্তার করতে সুবিধা পাবেন শি।

কীভাবে সিসিপির নেতা নির্বাচন হয়?

চীনের ৩৪ প্রদেশ ও অঞ্চলের সিসিপির উচ্চ পদের সবপর্যায়ের ২৩ হাজার ৩০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে সম্মেলন হয়। তারাই সিসিপির শীর্ষ জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য ৪০০ সদস্যকে নির্বাচিত করবেন। কেন্দ্রীয় কমিটির ২০০ সদস্য ভোটের মাধ্যমে ২৫ সদস্যের পলিটব্যুরো (মন্ত্রিসভা) ও সিসিপির সাত সদস্যের অভিজাত পলিটব্যুরো-পিএসি ( অভিজাত মন্ত্রিসভা) নির্বাচিত হবেন। পর্যবেক্ষকরা পিএসসি সদস্য নিয়োগের দিকেই নজর রাখছেন।

টলি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জের গবেষক এডওয়ার্ড নাইট এবং রুবি ওসমান ব্লগ পোস্টে বলেন, তত্ত্বানুসারে, সিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির ২০০ সদসরাই দলটির বড় নেতাদের নির্বাচন করবেন। বাস্তবে, অভিজাতরা এরইমধ্যে পছন্দের প্রার্থীদের শীর্ষ আনা নিশ্চিত করতে কয়েক মাস চেষ্টা করেছিলেন। তবে এ সময়ের মধ্যে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং কারা নেতৃত্বে আসবেন তা মোটামুটি চূড়ান্ত হয়েছে।

সাধারণত একটি বছরে, সিসিপির শীর্ষ পদের নিয়োগ পদোন্নতি এবং অবসরের জন্য অর্ভ্যন্তরীণ কর্মযজ্ঞ নির্ধারণ করা হয়। সাতটির ওপরে বা আটটির নিচে সম্মেলন ৬৭ বছরের বা তার নিচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়।  তবে ৬৮ বছরের বেশি হলে তাকে অবসরে পাঠানো হয়।

২০০৭, ২০১২, ২০১৭ সালের সম্মেলনে ৬৮ বছরের বেশি কাউকে নতুন পলিটব্যুরো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদি বয়সের নিয়মকে সম্মান করা হয়, তবে অন্তত পিএসসির সাত সদস্যের মধ্যে দুই সদস্যকে অবসরে পাঠাতে হবে। আর ১৮ পলিটব্যুরোর মধ্যে আটজনকে অবসরে যেতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকিংন্স ইনস্টিটিউনে আয়োজিত সভায় চীন বিশেষজ্ঞ চেং লাই বলেন, এ বয়স সীমা বর্তমান সময়ে পলিটব্যুরো এবং পিএসসির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

গত সেপ্টেম্বরে সিসিপির প্রকাশিত নতুন নিয়মে বয়সের নিয়ম উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি পদোন্নতি বা অবনতির কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এর পরিবর্তে সিসিপির নেতৃত্বের অনুগত্যের জন্য ১৫টি নিয়ম যুক্ত করা হয়েছে।

চেং বলেন, নুতন পরিবর্তন আগের সম্মেলনের চেয়ে ব্যক্তির পরিবর্তন করবে। এতে শুধু শি জিনপিং থাকবেন এবং শুধু ১৯৫০ সালে জন্ম নেয়া লি জানসু যাবেন।

তবে চেং জানানা, পিএসসির ছয় সদস্যের পাঁচ বছর সময় হাতে রয়েছে। এখন কে থাকবে, কে থাকবে না- বিষয়টি বেশ জটিল। এটি শি জিনপিংয়ের জন্য কঠিন। এ নিয়ে অবশেষে তিনি বিরক্ত হতে পারেন।

কে হবেন প্রধানমন্ত্রী?

সিসিপির দ্বিতীয় ব্যক্তিই চীনের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দুইবার পালন করা যায়। এখন সিসিপির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি হচ্ছেন লি কেগিয়াং। দুই বার দায়িত্ব পালন করায় তিনি সেই পদ থেকে অবসর নেবেন। এখন তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন চীনের চতুর্থ স্থানের উপ-প্রধানমন্ত্রী হান জেং, আরেক উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পলিটব্যুরো সদস্য জু চানহুয়া। লি হে নামের আরেক উপ-প্রধানমন্ত্রী (শি’র বাল্যবন্ধু) প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে আছেন। এছাড়া সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী ও দক্ষিণের অর্থনৈতিক শক্তির প্রদেশ গোয়াডংয়ের সিসিপি প্রধান ওয়াং ইয়াং।

নাইট ও ওসমান লিখেন, প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। ২৩ সেপ্টেম্বর সম্মেলন শেষ ওয়ার আগেই শি সেটি নির্ধারণ করবেন। বর্তমান চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের বয়স ৬৭ এবং শি জিনপিংয়ের চেয়ে তরুণ।

হার্ট বলেন, ভবিষ্যতে কী ঘটছে তা বলা মুশকিল। তাকে (প্রধানমন্ত্রী) সম্ভব অবসরে পাঠানো হবে। কিন্তু যেকোনো একটি পদে থাকে দেখা যেতে পারে। তিনি ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের চেয়ারম্যান হতে পারেন। এজন্য একটি অনুমান আছে।

পিএসসিতে কী নারী নির্বাচিত হবে?

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) অভিজাত পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটিতে কোনো নারী দায়িত্ব পালন করেননি। পলিটব্যুরোর ২৫ সদস্যের মধ্যে সান চানলান একমাত্র নারী। তার বয়স ৭২ হওয়ায় তাকে অবসরে পাঠানো হতে পারে।

সম্মেলনে চীনের নীতি আলোচ্য কী হবে?

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে থাকার প্রত্যাশা করছেন শি জিনপিং। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের অভ্যন্তরীণ এজেন্ডা পরিবর্তেনের চেয়ে আগেরটি বেশি চলার সম্ভাবনা রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক লওই ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলে জেনিফার সু বলেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে চীন নিজেকে খুঁজে পায় এবং বার্ধক্য জনসংখ্যা থেকে ক্রমবর্ধমান ঋণ পর্যন্ত অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। সিসিপির এ সম্মেলনে দলটির ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শির চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হবে। এতে পার্টি শক্তিশালী নেতার স্থিতিশীলতার দিকে দৃষ্টিতে জোর দেওয়া হবে না।

তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন দৃঢ়ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের দখলে এবং আসন্ন কংগ্রেসে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং, নীতি পরীক্ষা বা স্থানীয় উদ্ভাবনের জন্য খুব কম জায়গা থাকবে।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষকরা শি জিনপিংয়ের কাছে দৃঢ়তা প্রত্যাশা করছেন। বেজিংয়ের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির জন্য ওয়াশিংটন চিন্তিত। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে তলানিতে রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে শি নজর দিয়েছেন এবং হংকং ও তাইওয়ানের দিকে আক্রমণাত্মক পথে এগোচ্ছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা জার্মান মার্শাল ফান্ডের এশিয়া কর্মসূচির বনি গ্লাসার বলেন, তৃতীয় মেয়াদে শি জিনপিং আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরো অভিলাষী এবং আক্রমণাত্মক হবেন। সূত্র- আলজাজিরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *