গণপরিবহনসহ জনসমাগমের স্থানে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন শিশু, কিশোরী ও নারীরা

জাতীয় স্লাইড

আগস্ট ৩১, ২০২২ ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

শামীম রহমান রিজভী

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে যে জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে নারীদের সমান অবস্থান রয়েছে। তবুও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশী নারীরা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কার্যত সমাজে এবং আইনের প্রয়োগে নারীরা এখনও বৈষম্য, বর্জন ও অবিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাদের নগণ্য প্রভাব রয়েছে। দেশে পাবলিক বাসে যাতায়াত অথচ যৌন হয়রানির শিকার হননি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দেশের মহাসড়ক, ফুটপাত কিংবা জনসমাগম হয় এমন জায়গায় দৈনন্দিন প্রয়োজনে চলা ফেরার সময় ঠিক কতজন যৌন হেনস্তার শিকার হন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান জানা যায় না।

পূর্বে যেমন সবসময় লক্ষ্য করা যেত যে নারী, শিশু ও মেয়েদের জন্য গণপরিবহনে আলাদা বসার আসন থাকত। কিন্তু এখন গণপরিবহনে নারী ও শিশুদের জন্য আসনের কথা লেখা থাকলেও তা কেউ দেখেও দেখেন না। কোন কোন গণপরিবহনে তো নারী ও শিশুদের জন্য আসনের কথা এখন লেখাও থাকে না। আর এই সময়েই নারী ও মেয়ে শিশুদের ওপর ঘৃণিত মানসিকতার পরিচয় দেয় কেউ কেউ। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটি এক ধরনের ইউফেমিজম (Euphemism)। এ ধরনের ঘটনা নারীর স্বাধীনতা ও নিরাপদে পথ চলার মৌলিক অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। যা সংবিধান লঙ্ঘন।

চলতি বছরের গত ২৪ জুলাই রাতে রাজধানীতে চলন্ত বাসে শ্লীলতাহানির শিকার হন এক ছাত্রী। বিকাশ পরিবহনের ওই বাসে ধানমন্ডি থেকে আজিমপুরে ফেরার পথে ফাঁকা বাহনটিতে এ হয়রানি করে বাসটির হেলপার। চলন্ত যান থেকে লাফিয়ে কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচেন ওই তরুণী। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে আজিমপুরগামী বিকাশ পরিবহনের বাসে ওঠেন এক ছাত্রী। নীলক্ষেত মোড়ে সব যাত্রী নেমে গেলে একা হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তার পাশে বসে শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে বাসের হেলপার। চিৎকার করলে চালক গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। সিট থেকে উঠে নামার চেষ্টা করলে হেলপার তাকে বাধা দেয়। এরই একপর্যায়ে আজিমপুর গার্লস স্কুলের সামনে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন ওই ছাত্রী।

গত বছরের ১৫ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী একটি নাইট কোচে তরুণীকে পর্ন ভিডিও দেখানো এবং উত্যক্ত করায় এক যুবককে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একইসঙ্গে তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

২০১৯ সালের ১০ আগষ্ট রাতে চট্টগ্রাম মহানগরে চলন্ত বাসে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটে। তবে সেই নারীর চিৎকারে শুনে পেছনে থাকা গরুবোঝাই একটি ট্রাকের চালক বাসটির গতিরোধ করেন। এরপর স্থানীয় লোকজন বাসের চালক ও তার সহকারীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসেই লাব্বাইক পরিবহনের একটি বাসে বাংলাদেশ লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন পরিবহনশ্রমিকেরা। একই বছর মার্চ মাসে নিউ ভিশন নামে একটি বাসে দুই নারীকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করা হয়। একই মাসে এক কলেজছাত্রী একটি ফাঁকা বাসে উঠলে একই রকম ঘটনার শিকার হন।

শুধু যে বাসে নারীদের হয়রানি করা হচ্ছে তা নয়, মার্কেটে, পথেঘাটে, কর্মস্থলে নারীরা যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। নারী ও মেয়েদের জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ গত ২০ বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমছে এবং স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতাও বেশি। একই সময়ে ৮২ শতাংশ বিবাহিত মহিলা লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হন এবং ব্যাপক যৌন সহিংসতা মহিলাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনে বাধা দিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ‘‘সকল বয়সের নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে, সচেতনতার পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত মানসিক সমর্থন করতে হবে এবং বুঝাতে হবে যে জীবন এতো মূল্যহীন নয়৷ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষা প্রাধান্য দিতে হবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবাইকে সচেতন হতে হবে৷ সর্বোপরি নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে৷”

ইউনিসেফ এর তথ্য মতে, যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো ধরাটা বেশ কঠিন। সামাজিক সংস্কার আর প্রভাবশালীদের চক্ষুশূল হওয়ার ভয়ে এমন অপরাধও চাপা পড়ে যায়। আইন ও শিশুর সুরক্ষা সেবাগুলো সম্পর্কে অধিকাংশ বাবা-মা’র ভালো ধারণা নেই। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন আছে। তবে তা যৌন হয়রানির ঘটনাকে আমলে নেয় না। অথচ যৌন হয়রানির প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে কিশোরীরা আত্মহত্যা করে অথবা আরও সহিংসতার শিকার হন। কর্মসংস্থানের অভাবে অনেক কিশোরী অনিরাপদ মাইগ্রেশনের দিকে ঝুঁকছেন। এই শিশুরা পদে পদে নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকেন।

বেসরকারী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপরিবহনে চলাচল করা কিশোরী-তরুণী ও নারীদের ৬৩ শতাংশ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। এরমধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন। যৌন হয়রানির শিকার এই নারীদের প্রায় অর্ধেকসংখ্যক (৪৫ শতাংশ) পরবর্তী সময়ে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠা-নামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাজেভাবে স্পর্শ, বাজে মন্তব্য ও ধাক্কা দেওয়া। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেননি। যৌন হয়রানির পাশাপাশি ১৫ শতাংশ বুলিং, ১৫ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৫ শতাংশ লিঙ্গবৈষম্য এবং ৮ শতাংশ শারীরিক গঠন নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

জরিপ প্রতিবেদনে রাজধানীর বাস, ট্রেন, লেগুনা, রাইড শেয়ারিং বাহনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গুলশান, আজিমপুর, মিরপুর, বনানী, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী নারী ও কিছু সংখ্যক গৃহবধূর ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপ শুরুর সময়ের ৬ মাস আগপর্যন্ত হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন এমন নারীদের তথ্য যুক্ত করা হয়। অফলাইন ও অনলাইনে জরিপ করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়।

কারা যৌন নিপীড়ন করেছে জানতে চাইলে জরিপে অংশ নেওয়া ৭৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা অন্য যাত্রীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন। গণপরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীর হাতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। ২০ শতাংশ চালকের সহকারী, ৩ শতাংশ হকার এবং ২ শতাংশ চালকের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। জরিপে ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৮০৫ জন নারী ও মেয়ে শিশু অংশ নেন। এর মধ্যে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৬ শতাংশ। প্রায় ৬২ শতাংশ শিশু, কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৩৬ শতাংশ জানিয়েছেন, কিশোর ও যুবকদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়াও নারী যাত্রী ওঠানো-নামানোর সময় চালকের সহকারীদের নেমে দাঁড়ানোর কথা থাকলেও তারা বাসের দরজায় অবস্থান করে অযাচিতভাবে স্পর্শ করে বলে অভিযোগে এসেছে।

ইউনিসেফ এর তথ্য মতে, শিশুর সুরক্ষা দেয় এমন আইনগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে, সহিংসতা, শোষণ-বঞ্চনা এবং কোনোভাবে শিশুর প্রতি অবহেলা মেনে নেওয়া হবে না। শিশু ও কিশোরীদের সুরক্ষায় শিশু আইন ২০১৩ বাস্তবায়নে কৌশলগত প্রচারণার পাশাপাশি কারিগরি সহযোগিতা দেয় ইউনিসেফ। সহিংসতাসহ শিশুর অধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে আরও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং গবেষণায় আরও জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলোও শারীরিক শাস্তি ও যৌন সহিংসতার বিষয়ে অভিযোগ করে থাকে।

আচঁল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, “আমরা জরিপে দেখেছি আপত্তিকর স্পর্শ এবং বডি শেমিং-এর বিষয়টি এখন অনেক বেড়ে গেছে৷ আগে বডি শেমিংকে মানুষ তেমন গুরুত্ব দিত না৷ কিন্তু এখন এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অন্য ধরনের যৌন হয়রানিও কমেনি৷ বিশেষ করে গণপরিবহন এখন তরুণীদের জন্য একটা আতঙ্কের জায়গায় পরিণত হয়েছে৷ আমরা বডি শেমিং-এর ব্যাপারে আইনের প্রস্তাব করেছি৷ অন্যান্য যৌন হয়রানির ব্যাপারে আইন থাকলেও ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পান না বা প্রতিকারের জন্য যান না৷ এর পেছনে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রধানত দায়ী৷ আর মামলা করলে অনেক সময় উল্টো অভিযোগকারীকেই হয়রানির শিকার হতে হয়৷”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *