কিশোর গ্যাং ঠেকাতে ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে সারাদেশে

দেশজুড়ে

অক্টোবর ২২, ২০২২ ৯:৩২ অপরাহ্ণ

এ এফ সাফায়েত জামিল

রাজধানীসহ সারাদেশে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়া কিশোর গ্যাংয়ের তেজ রোধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। পাড়া মহল্লায় দাপিয়ে বেড়ানো অদ্ভুত অদ্ভুত নামের এক একটি গ্রুপ যেন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের উপর হামলা, খুন, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের ভয়ংকর মহড়া, মাদক সেবন ও বিক্রি, চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা কিশোর গ্যাংগুলোর রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সচেনতা বাড়ানোর সঙ্গে কিশোর কারাগার নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
পুলিশ বলছে, সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। ডাটাবেজের কাজ সম্পন্ন হলে তালিকা ধরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, গত ৫ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খোদ ঢাকাতেই প্রায় অর্ধ শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা, ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া, প্রতিপক্ষকে কুপিয়ে জখম, অস্ত্রের মহড়ার ঘটনাও তাদের রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। ঢাকায় গত ৫ বছরে র‌্যাব ও পুলিশের হাতেই কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত সহস্রাধিক সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। এদের প্রত্যেকের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর।
র‌্যাব সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, র‌্যাব সর্বমোট ৮৭টি অভিযানে ৫২টি কিশোর গ্যাংয়ের ৬৭৪ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ১৩টি অভিযানে ১৩টি কিশোর গ্যাংয়ের ৬৬ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।
জানা গেছে, ঢাকায় শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এ তিন এলাকায় অর্ধ শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে ‘টক্কর ল’, ‘পাটোয়ারী’, ‘মুখে ল’, ‘পাঁয়তারা কিংস’, ‘দে ধাকা’, ‘লারা দে’, ‘লেভেল হাই’, ‘গুতা দে, ‘মার ভাণ্ডার’, লাল গ্রুপ, টক্কর ল (জুনিয়র)’, ‘ল ঠেলা’ ‘আতঙ্ক গ্রুপ’, ‘ডায়মন্ড গ্রুপ’, ‘কাউসার গ্রুপ’, কাউসার গ্রুপ-২’, ‘কোম্পানি বাড়ি গ্রুপ’, ‘কালা আয়সা কিশোর গ্যাং’, ‘ক্যাস্তা ফিরোজ ৪০ ফিট গ্রুপ’, ‘ভাইগ্যা যা গ্রুপ’ সক্রিয় রয়েছে। তাদের ইন্ধন দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা।

উত্তরার অপরাধ সংঘটন করছে ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং। এর মধ্যে রয়েছে জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, বিগ বস, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, তালা চাবি গ্যাং, নাইন স্টার, নাইন এমএম বয়েজ, পোঁটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, এনএনএস, এফএইচবি, রনো, কে নাইন, ফিফটিন গ্যাং, থ্রি গোল গ্যাং, শাহীন রিপন গ্যাং, নাজিম উদ্দিন গ্যাং, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফানসহ নামে বেনামে বিভিন্ন গ্যাং। এসব গ্রুপে সক্রিয় পাঁচ শতাধিক কিশোর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন সেক্টর এলাকায়। কোনো কোনো গ্রুপে ৮০ থেকে ১০০ জন সদস্যও রয়েছে। উত্তরার কিশোর গ্যাং স¤্রাটদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাকিবুল হাসান সানি, আক্তারুজ্জামান ছোটন, মো. নাজমুল হুদা নাদিম ও মো. বাহাউদ্দিন হাসান শাওন ওরফে গ্রিল শাওন। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকায় উত্তরায় বন্ধ হচ্ছে না গ্যাং কালচার।
শুধু ঢাকাতেই নয়, দেশের সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে গ্যাং কালচার। যার সর্বশেষ উদাহরণ আশুলিয়ার পলাশবাড়ীতে কাইচ্চাবাড়ি কিশোর গ্যাং ও গোচারটেক ভাই-ব্রাদার কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে সংঘর্ষের সময় নির্মমভাবে লিখনকে (১৮) হত্যার ঘটনা। এ ঘটনায় গত ১১ অক্টোবর ৪ জনকে গ্রেপ্তারের পরে র‌্যাব জানায়, পলাশবাড়ী থেকেই বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি গ্যাংয়ের অন্তত ৫০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সামাজিক পরিবর্তন, আধুনিক পরিবার, প্রযুক্তি, খেলাধূলার ও সংস্কৃতি চর্চার জায়গা না থাকা এবং মাদকের ডামাডোলের মধ্যে কিশোরদের মানসিক বিকাশ যথার্থভাবে গড়ে উঠছে না। নিজেরাই নিজেদের মতো একটা দুনিয়া ভেবে নিচ্ছে এবং হতাশাগ্রস্ত থাকছে। ফলে নতুন জেনারেশন হিসেবে যারা বেড়ে উঠছে, তাদের অনেকেই গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। শুধু আইনগতভাবে মোকাবিলা করে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকে। পাশাপাশি স্কুলে ও কলেজে সপ্তাহে একদিন মানসিক বিকাশের জন্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য সাইকোলজিস্টের মাধ্যমে ক্লাস নিতে হবে। এছাড়াও কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং আরো জোরদার করতে হবে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউশনের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, প্রভাবশালীদের কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে, অনেকে রাজনৈতিক স্বার্থে, কেউ আধিপত্য বিস্তার করতে এবং মাদক বিক্রিতেও কিশোর গ্যাং সদস্যদের ব্যবহার করছে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর কিশোরদের আটক করা হলেও নেপথ্যের কারিগররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। আর শিশু আইনে কিশোরদের সংশোধনাগারে পাঠানো হয় অথবা পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। যা কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়। সময় এসেছে কিশোর কারাগার তৈরি করে, সেখানে কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখার।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ২ লাখের মতো ভাসমান শিশু রয়েছে। মানসিক বিকাশের সুযোগ না পাওয়া এসব শিশুদের অপরাধে বা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। তাদের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) এ কে এম হাফিজ আক্তার ভোরের কাগজকে বলেন, কিশোরদের অপরাধ করার প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেভাবে বিভিন্ন নামে গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে, সেটি আগে ছিল না। বিশেষ করে রাজধানীর উত্তরা ও মোহাম্মদপুরসহ বেশকিছু এলাকায় গড়ে ওঠা এসব গ্রুপ ছুরি মেরে হত্যা করাসহ নানা অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে ডিএমপির প্রত্যেক থানাকে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তালিকা হাতে পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিশোরদের জন্য আইন একটু আলাদা। এজন্য অপরাধ বড় না হলে মুচলেকা নিয়ে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। তবে, এটি থেকে মুক্তি পেতে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সব শ্রেণি পেশার মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ভোরের কাগজকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ, মাদক ব্যবসায়ী ও অপরাজনীতি করা লোকদের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে উঠতি বয়সে না বুঝেই নানা অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ে। এটি থেকে মুক্তি পেতে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, সমাজের প্রত্যেক অংশীজনকে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোরদের আগেই সচেতন করে তুলতে হবে, তারা যেন অপরাধের পথে পা না বাড়ায়।
যারা কিশোর গ্যাংদের প্রশ্রয় দেয়, তাদের আইনের আওতায় আনতে তেমন একটা দেখা যায় না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন কোনো অপরাধে থানায় মামলা হয়, তখন নেপথ্যে যে বা যারাই থাকে, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো অভিযোগ না পেলে এই সুযোগ নেই।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পিআর) মো. মনজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কমাতে সারাদেশের তালিকা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে তালিকা তৈরির কাজও চলছে। তালিকা তৈরি হলে ডাটাবেজ করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের নামে কোথাও অপরাধ সংগঠিত হলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। বিট ও কমিউনিটি পুলিশও তৎপর রয়েছে। এসব কিছুর বাইরে কিশোর গ্যাং কালচার কমাতে সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *