আমি কখনো বুকারের স্বপ্ন দেখিনি

আন্তর্জাতিক

জুন ৩, ২০২২ ১:০৮ অপরাহ্ণ

গত ২৭ মে লন্ডনের মেরিলেবোনে ঘোষণা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ২০২২। প্রথমবারের মতো ভারতীয় লেখক হিসাবে গীতাঞ্জলী শ্রী এ পুরস্কার পেয়েছেন। হিন্দি ভাষায় লেখা ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসের জন্য এ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

গীতাঞ্জলী শ্রীর আগে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় এ পুরস্কার আর কেউ পায়নি। তবে ইংরেজিতে লেখার জন্য সালমান রুশদি, অরুন্ধতী রায়, ভি এস নাইপল ও কিরণ দেশাইসহ আরও কয়েকজন লেখক বুকার ও ম্যানবুকার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। যুক্তরাজ্য বা আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজিতে লেখা বা ইংরেজিতে অনূদিত উপন্যাসগুলো এ পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়ে থাকে।

গীতাঞ্জলী শ্রীর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১২ জুন ভারতের উত্তর প্রদেশের মৈনপুরি জেলায়। তার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। বাবার বদলি চাকরির সুবাদে ছোটবেলা কেটেছে উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দেখেছেন মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন। খুব কাছ থেকে অবলোকন করেছেন ঘাটে ঘাটে বাঁধা জীবনের নানা বাঁকগুলো। আত্মার নিবিড়তম অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন চারপাশের মানুষগুলোর সুখ দুঃখের প্রকাশিত ও নিভৃত গল্পগুলো। শৈশব-কৈশোরের বৈচিত্র্যময় একগুচ্ছ ঘটনার অনবদ্য শিল্পায়ন তার ‘রেত সমাধি’ উপন্যাস।

গীতাঞ্জলী শ্রীর মতে-তখনকার সময়ে আজকালকার মতো ইংরেজির চেয়ে হিন্দি বই, পত্রিকা ও ম্যাগাজিন সহজলভ্য ছিল বেশি। তাই হিন্দি ভাষায় লেখা বই-ই পড়া হতো বেশি। তখন থেকে হিন্দির প্রতি অনুরাগ আর ভালোবাসার জন্ম। আর মাতৃভাষা হিন্দি হওয়াতে লেখালেখির জন্য হিন্দি ভাষার ক্ষেত্রটি ছিল সুপরিসর ও স্বাচ্ছন্দ্যের। সেখান থেকেই ‘রেত সমাধি’ হিন্দিতে লেখা।

গল্পের মাধ্যমেই মূলত তার লেখালেখির সূচনা। ১৯৮৭ সালে ‘হান্স’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় প্রথম ছোটগল্প ‘বেলপত্র’। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় ছোটগল্পের বই ‘অনুগুঞ্জ’। গীতাঞ্জলী শ্রীর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের নাম ‘গধর’। এ পর্যন্ত তার মোট পাঁচটি উপন্যাস ও বেশকিছু সংখ্যক ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজিতে অনূদিত তার লেখা ‘মাই’ উপন্যাসটি ২০০১ সালে ক্রসওয়ার্ড বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিল। গীতাঞ্জলী শ্রীর লেখা ইংরেজি ছাড়াও জার্মান, ফরাসি, কোরিয়ান ও সার্বিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

গীতাঞ্জলী শ্রীর মতে, আমি কখনো বুকারের স্বপ্ন দেখিনি! এমনকি পুরস্কার ঘোষণার আগ পর্যন্ত ভাবিনি যে ‘রেত সমাধি’ আমাকে এত বড় স্বীকৃতি এনে দেবে। আমি বিস্মিত, আনন্দিত ও সম্মানিত। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘রেত সমাধি’ হিন্দি থেকে ইংরেজিতে ‘টুম্ব অব স্যান্ড’ নামে অনুবাদ করেন যুক্তরাষ্ট্রের অনুবাদক ডেইজি রকওয়েল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর সৃষ্ট পৃথক সীমান্ত কীভাবে দুই দেশের লক্ষ কোটি মানুষের মধ্যে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট ও যন্ত্রণা বয়ে এনেছিল তার অন্তর্মুখী উপলব্ধির তুলিতে শব্দবন্দি করেছেন গীতাঞ্জলী শ্রী। প্রিয়জনকে ছেড়ে আসার কষ্ট, চেনা পথ পেছনে ফেলে আসার কষ্ট, চেনা পরিবেশ ছেড়ে অচেনা জায়গায় নিজেকে স্থানান্তরের কষ্ট। প্রিয় প্রাণী, পাখি, বৃক্ষ, ঘরবাড়ি, পুকুর, শস্য খেত ফেলে আসার কষ্ট। প্রিয়জন হারানোর কষ্ট। কাঁটাতারে আঁটকে পড়া এ রকম অজস ঘটনা জীবন্ত ছবির মতো লেখক তুলে এনেছেন তার সুনিপুণ বর্ণনায়। যা পড়তে গিয়ে পাঠক যেমন ক্ষণে ক্ষণে আপ্লুত হবেন ঠিক তেমনি মর্মস্পর্শী অনুরণনে উদ্বেলিত হয়ে পড়বেন।

‘রেত সমাধি’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আশি বছর বয়সি এক বৃদ্ধা। যে কিনা স্বামী মারা যাওয়ার পর একা হয়ে পড়েন। স্বামীকে হারিয়ে অমানিশার বিষাদে ছেয়ে যায় তার গোধূলি জীবন। ভীষণ নির্বিকার আর চুপচাপ হয়ে পড়েন তিনি। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুদিন। এক সময় হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠেন তিনি। সাহসী এক অন্য মানুষের মতো আবিষ্কার করেন নিজেকে। বেরিয়ে পড়েন নিজের শেকড়ের সন্ধানে।

দেশভাগের সময় পৃথক হয়ে যাওয়া পাকিস্তানে যাওয়ার চিন্তা মাথায় ঢোকে তার। পা বাড়ান সীমানার বাইরে। বয়স কিংবা কাঁটাতার কিছুতে অবরুদ্ধ করতে পারে না তাকে। শুরু হয় দুঃসহ অভিযান। আশি বছর বয়সি বৃদ্ধার দুঃসাহসিক অগস্ত্য যাত্রার হৃদয় ছোঁয়া এক গল্প সাতশ পৃষ্ঠার কাগজে শব্দের বুননে সুখপাঠ্য ও হৃদয়গ্রাহী করে এঁকেছেন গল্পকার ও ঔপন্যাসিক গীতাঞ্জলী শ্রী তার এ উপন্যাসে।

গল্পে ঘটনা বিন্যাস ও বর্ণনার মাধ্যমে লেখক মূলত বয়স হয়ে গেলে প্রতিটি মানুষই যে এক ধরনের একাকিত্ব ও স্মৃতিকাতরতায় ভোগে তা বলার প্রয়াস পেয়েছেন। গল্পের কাহিনি পরিক্রমায় লেখক সেই সময়ের মৌনকষ্ট ও অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সংলাপে। জীবন যতই বর্ণিল হোক না কেন, জীবনে যতই উচ্ছ্বাস কিংবা আনন্দ জুড়ে থাকুক না কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর মানুষ নিষ্প্রাণ ও নির্জীব হয়ে পড়ে। নিজের কাছে হয়ে যায় খুব একা। সে সময়গুলো বড় কষ্টের।

অদৃশ্য তীরের সন্ধানে তখন দিগ্বিদিক ছুটে চলে জীবন নামের এ দোদুল্যমান নৌকা। বুকার প্যানেলের বিচারক ফ্রাংক ওয়েইনের মতে-বইটির চিত্রকল্প, কাহিনি ও চরিত্রাবলি খুব সহজে যেমনভাবে পাঠককে বিমোহিত করবে ঠিক তেমনি ঘটনা পরিক্রমা ও বর্ণনা নিমিষেই আবার শোক সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। দেশভাগ ও তার নীরব যন্ত্রণার অবারিত ঘটনার একটি হৃদয়গ্রাহী গল্প আত্মপোলব্ধির নিরিখে আবেগের অভিস বণে উপস্থাপিত করেছেন লেখক এ উপন্যাসে। শৈশবে উত্তর প্রদেশে থাকাকালীন সেখানকার স্থানীয় স্কুল থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করে নয়াদিল্লির লেডী শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন গীতাঞ্জলী শ্রী। তারপর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি করেছেন বারোদার মহারাজা সায়াজিরাও ইউনিভার্সিটি থেকে। চৌষট্টি বছর বয়সি এ লেখক বর্তমানে দিল্লিতে বসবাস করছেন। লেখালেখিতেই নিষিক্ত করেছেন জীবনের যত ইচ্ছেকুঁড়ি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *