বাঁকখালি সদর বিটে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব

দেশজুড়ে

এপ্রিল ২৫, ২০২২ ৪:১২ অপরাহ্ণ

এস এম হুমায়ুন কবির, কক্সবাজার

কক্সবাজার জেলার উত্তর বনবিভাগের বাঁকখালি রেঞ্জের বাঁকখালি বিটের প্রায় দশ একর সামাজিক বনায়ন কেঁটে উজাড় করে ফেলার অভিযোগ উঠেছে খোদ বাঁকখালি বিট কর্মকর্তা রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে। কাউয়ারখোপের কলারঝিরির শুকরেরতলী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় দশ একর জায়গার হাজার হাজার গাছ কেঁটে ফেলা হয়েছে। গাছ কাটার পর গাছের গুড়ি নিছিন্ন করতে পাহাড়ে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে আগুন।

শনিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, কলারঝিলির সংরক্ষিত বনভূমির পাহাড়ি নিচু জমিতে শত শত একরজুড়ে করা হয়েছে তামাক চাষ। অভিযোগ আছে বাঁকখালি বিট কর্মকর্তা প্রতি একরে দশ থেকে বিশ হাজার টাকা নিয়ে স্থানীয় ভিলেজার ও বাসিন্দাদের তামাক চাষ করতে বর্গা দিয়েছেন সংরক্ষিত বনভূমির শত শত একর জমি।

পাশাপাশি সরকারি সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আকাশমনি, মির্জা গাছসহ হাজার হাজার গাছ কাটা দেখা যায়। অনেক গাছ কাটার পর এখনো ফেলে রাখা হয়েছে এখানে। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সরে পড়েছেন তামাক চাষীরা ও গাছ কাটায় জড়িতরা।

বাঁকখালি রেঞ্জের হেডম্যান আব্দুস ছালাম বলেন, আমি নিজে বাদী হয়ে বনবিভাগের পক্ষে এসব সংরক্ষিত বনভূমি রক্ষায় আদালতে মামলা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় খোদ বিট কর্মকর্তা রবিউল বন সংরক্ষক হয়ে প্রকাশ্যে কিছু বনদস্যুদের সাথে নিয়ে প্রায় দশ একর সংরক্ষিত বনভূমির গাছ কাঁটিয়েছেন, পাশাপাশি টাকার বিনিময়ে সংরক্ষিত বনভূমিতেই তামাক চাষ করার অনুমতি দিচ্ছেন তিনি। আমরা তিনজন হেডম্যান এসব বনভূমির দেখাশোনা করি। এখন আমরা হেডম্যান হয়েও নিরুপায়। বিট কর্মকর্তা রবিউলের বিরুদ্ধে কথা বললে তিনি আমাদের বন মামলার ভয় দেখান।

শুধুমাত্র এখানেই শেষ নয়। বাঁকখালি বিট কর্মকর্তা রবিউলের বিরুদ্ধে আছে মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ। এই বিটের অধিকাংশ সংরক্ষিত বনভূমিতে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে বসতি। অভিযোগ আছে টাকা না দিলে বনভূমিতে নিমিষেই করা যায় ঘর আর না হয় দেওয়া হয় বন মামলা।

এদিকে, দশ একর জায়গার গাছ কেঁটে উজাড় ও সংরক্ষিত বনভূমিতে তামাক চাষে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে বিট কর্মকর্তা রবিউল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কেনো বনবিভাগের গাছ কাটবো, দুষ্কৃতীকারীরা হয়তো এই গাছগুলো কেঁটেছে। প্রায় দশ একর বনভূমির হাজার হাজার গাছ কাঁটলেও কারা এই গাছ কেঁটেছে তা নিয়ে তিনি কিছু জানেন না বলেও জানান।
তিনি আরও বলেন, সংরক্ষিত বনভূমিতে যারা তামাক চাষ করে এদের হাত অনেক লম্বা। আমরা তাদের তামাক চাষ না করতে মানা করলেও শুনে না। যুক্ত করে বলেন, আপনারা সাংবাদিকেরা শুধু কি আমাদের বিট দেখেন? তামাক চাষ শুধু আমাদের বিটের সংরক্ষিত বনভূমিতে নয় সারা বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনভূমিতে হচ্ছে।

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের অধিকাংশ সংরক্ষিত বনভূমিতে তামাক চাষ ও অবাধে পাহাড় কাঁটা নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ। তার মধ্যে অধিকাংশই এই বনবিভাগের বিভিন্ন বিটের কর্মকর্তার নাম উঠে আসছে। এনিয়ে কক্সবাজারে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাপা ইতোমধ্যেই নানান কর্মসূচি পালন করেছে।

কাউয়ারখোপের স্থানীয় কৃষক মোস্তাক আহমদ জানান, কলারঝিরির সব সংরক্ষিত বনভূমি এখন তামাক চাষের দখলে। রাজারকুল রেন্জের বাঁকখালি বিট কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম সরাসরি এসে এখানকার কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি একরে পনের থেকে বিশ হাজার টাকা বর্গার টাকা নেন। তাছাড়া চাষা দিয়ে তিনি নিজেও অনেক তামাক চাষ করেছেন এখানে।

ভিলেজার আব্দুর রহমান দীর্ঘদিন ধরেই কলারঝিরিতে বসবাস করেন। কিন্তু সরজমিনে দেখা গেছে, সংরক্ষিত বনভূমিতে তিনিও প্রায় দুই একর তামাক চাষ করেছেন। তামাক চাষের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিট অফিসকে প্রতি একরে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিলেই হয়। আমরা যেহেতু ভিলেজার আমাদের থেকে টাকা কম নেয় বিট অফিস।

সূত্র বলছে, প্রায় দশ একর সংরক্ষিত বনভূমির গাছ কেঁটে লাকড়ি বানিয়ে তামাক পোঁড়ানোর জন্য বিক্রি করেছেন এই বিট কর্মকর্তা রবিউল। নাম, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কাউয়ারখোপের স্থানীয় এক পিকাপ চালক বলেন, গত মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আমরা প্রায় সাতটি পিকাপ কলারঝিরির মুখ থেকে কিছু গাছ বহন করেছি। বিট কর্মকর্তা রবিউল নিজের প্রয়োজনে শুকরেরতলী থেকে এসব গাছ কেঁটেছিলেন বলে জানতে পারি। বিভিন্ন তামাক পোড়ানোর কারখানায় এসব গাছ নিয়ে যাই।

কক্সবাজার জেলার অধিকাংশ সংরক্ষিত বনভূমিতে অবৈধ পাহাড়—গাছ কাঁটা ও তামাক চাষের বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’র (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, শুধু রামুতে নয়, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, টেকনাফ ও ঈদগাঁওতে অনেক বন রক্ষকেরাই বন ধ্বংসে মেতে উঠেছে। স্থানীয় বনদস্যু—পাহাড়খেকোদের সাথে আতাত করে তারা বন রক্ষা না করে ধ্বংস করছে। আমরা ইতোমধ্যেই সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ অনেক বন বিভাগের কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই বনবিভাগের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়ে উঠে তাহলে আসলে বনভূমি রক্ষা করা কঠিন।

কক্সবাজার জেলার পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাদের দাবী তদন্ত কমিঠি গঠন করে দ্রুত বন ধ্বংসে বিট কর্মকর্তাসহ জড়িত অন্যান্য কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা হোক। কারা ভূমিদস্যু পাহাড় খেকোদের প্রশ্রয় দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হোক। রক্ষকদের মধ্যে যারা ভক্ষক হয়ে উঠেছে তাদের চিহ্নিত করা না গেলে সংরক্ষিত বনভূমির যা কিছু আছে তাও নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা তাদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *