যোগ্য উপাচার্য খুঁজে পাচ্ছে না সরকার

শিক্ষা স্লাইড

আগস্ট ২৭, ২০২৪ ২:৩৮ অপরাহ্ণ

দেশের ৪৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন কাণ্ডারিহীন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। সরকার পরিবর্তনের পর তাদের বেশির ভাগ পদত্যাগ করেন শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে। কোথাও কোথাও উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, ডিন, প্রক্টর ও হলের প্রভোস্টরা পদ ছেড়েছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে ১৬ দিন শূন্য থাকার পর গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উপাচার্যদের পদত্যাগপত্র আচার্য গ্রহণ করেছেন। তবে শূন্য পদগুলো দ্রুত পূরণ করা যাচ্ছে না। বেশ কিছু নাম নিয়ে কাজ চললেও সরকারের পছন্দমতো সব দিক থেকে উপযুক্ত ব্যক্তির খোঁজ মিলছে না।

মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, উপাচার্য নিয়োগে কিছু মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথমেই রয়েছে, গত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ও সমর্থনকারী কাউকে উপাচার্য পদে দেওয়া হবে না। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে একাডেমিক স্কলার হতে হবে। তৃতীয়ত, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং চতুর্থত, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে মোটা দাগে ‘গ্রহণযোগ্য’ হতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে বিতর্কমুক্ত ব্যক্তিদের উপাচার্য করতে চায় সরকার। কিন্তু একটি বা দুটি শর্ত পূরণ হলেও হয়তো অন্যটি হচ্ছে না। এ কারণে উপাচার্য নিয়োগে বেগ পেতে হচ্ছে।

সূত্রটি জানায়, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হবে না। বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হবে। উপাচার্য নিয়োগে অগ্রগতির বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়-২) নুমেরী জামান শুধু বলেন, ‘কাজ চলছে।’

দেশে এখন স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত চারটি এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫১টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে (অধিভুক্ত কলেজসহ) শিক্ষার্থী ৪৪ লাখের মতো।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান অন্তত ৪৪ জন উপাচার্য পদত্যাগ করার কথা জানান। উপ-উপাচার্য, ডিন ও কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগের হিসাব তাঁর কাছে নেই।

চাপের মুখে পদ ছেড়েছেন সবাই
পদত্যাগী উপাচার্যরা জানান, তাদের বেশির ভাগ ছাত্রদের চাপের মুখে সম্মান বাঁচাতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ব্যতিক্রম শুধু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানো প্রসঙ্গে গত রোববার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউকে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না। জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পেতে অসুবিধা হবে।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সম্পর্ক আশা করা হয়, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং কাউকে অপমান করা যাবে না।’

প্রশাসনিক শূন্যতা
১৯৭৩ সালের আদেশে চলা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই পদত্যাগ করেছেন। অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল পদত্যাগ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম পদত্যাগ করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (রুটিন দায়িত্ব) এ বি এম আজিজুর রহমান বলেন, ‘উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ না থাকায় প্রায় সব ধরনের কাজ বন্ধ রয়েছে।’

পদ ছেড়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাফিজা খাতুন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মশিউর রহমান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সত্যপ্রসাদ মজুমদার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ শামসুল আলম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেন, উপ-উপাচার্য মোসাম্মাৎ হোসনে আরা ও কোষাধ্যক্ষ অমিত রায় চৌধুরী।

উপাচার্যের পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের একাংশ পদত্যাগ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্যরা পদত্যাগ না করলেও পদত্যাগ করেছেন কয়েকটি হলের প্রভোস্ট। রেজিস্ট্রার পদে নেই কেউ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। প্রক্টরিয়াল বডি ও হল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য থাকায় আবাসিক হলগুলোয় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, প্রক্টরিয়াল বডি ও কয়েকটি হলের প্রভোস্ট পদত্যাগ করেন। গত ১৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনস্তার শিকার হন এক নারী শিক্ষার্থী। এ ঘটনার বিচার দাবিতে প্রক্টর অফিসে যান ভুক্তভোগীর সহপাঠীরা। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন পুরো প্রক্টরিয়াল বডি পদত্যাগ করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক দিনে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষসহ প্রায় ৩০ জন পদত্যাগ করেছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব কারণে গত রোববার ক্লাস শুরুর কথা থাকলেও তা হয়নি। এ ছাড়া নিরাপত্তা শঙ্কায় হলে আসেননি অনেক শিক্ষার্থী।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টরিয়াল বডি ও প্রভোস্টসহ প্রায় ৭০টি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, পদগুলো শূন্য থাকায় তারা নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার ছাড়া প্রশাসন, প্রক্টরিয়াল বডি, প্রভোস্টসহ ২০টি পদ থেকে শিক্ষকরা পদত্যাগ করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া প্রশাসনিক শূন্যতার কারণে আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত ২১ আগস্ট এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘৪০টিরও বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকশূন্য। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যত দ্রুত সম্ভব পরিবর্তন আনতে হবে। এটিকে সুযোগও মনে করি। আমরা চাই, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আসুক। তাদের শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকতে হবে। এতদিন এ জায়গায় আমাদের অবমূল্যায়ন হয়েছে।’ একসঙ্গে সব শূন্যপদ পূরণ করা চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পদায়ন দ্রুত করার কথা জানান তিনি।

বেতন-ভাতা নিয়ে শঙ্কা
উপাচার্যহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরের মতো পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সংকট না হলেও বেগম রোকেয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংকট দেখা দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বেতন-ভাতা নিয়ে শঙ্কিত। সংকট থেকে উত্তরণে দ্রুত উপাচার্য নিয়োগের দাবি জানান তারা।

নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমাদের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। কোষাধ্যক্ষের পদত্যাগের জন্য শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। অফিসগুলো সিলগালা, আমরা যেতে পারছি না। খুব সংকটময় পরিস্থিতি।’

তিনি বলেন, ‘উপাচার্যের অনুমোদন ছাড়া আগে বেতন হয়নি। তাঁর পদটি এখন শূন্য। এমন পরিস্থিতিতে মাস শেষে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে সমস্যা হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *