নভেম্বর ১৪, ২০২২ ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ
জীবনভর নির্বাসনই জুটেছিল কপালে। কাগজপত্রের অভাবে ঝা চকচকে শহরের বিমানবন্দরের কোনায় পড়ে থাকা চিলতে জায়গাটুকুই হয়ে উঠেছিল তার পরবাসের ঠাঁই।
টানা ১৮ বছর ফ্রান্সের প্যারিসের বিমানবন্দরে বসবাস করা ইরানের সেই ‘দেশহীন মানুষ’ মেহরান করিমি নাসেরি মারা গেছেন। স্থানীয় সময় শনিবার দুপুরে শার্লস দ্য গল বিমানবন্দরের টু-এফ টার্মিনালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিবিসি জানায়, ১৯৮৮ সালে প্যারিসের এই বিমানবন্দরে বসবাস শুরু করেন নাসেরি। নিজেকে স্যার আলফ্রেড নামে পরিচয় দিতেন।
বিমানবন্দরের লাল সোফায় বসে লিখতেন নিজের আত্মজীবনী। তার ‘দ্য টার্মিনাল ম্যান’ নামের সেই আত্মজীবনী ২০০৪ সালে বই হিসাবে প্রকাশ করেন ব্রিটিশ লেখক অ্যান্ড্রু ডনকিন। বই অবলম্বনে সে বছরই ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমা তৈরি করেন বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ।
ওই বছরই মুক্তি পাওয়া সিনেমাটিতে নাসেরির চরিত্রে অভিনয় করেন টম হ্যাঙ্কস। ছিলেন অভিনেত্রী ক্যাথেরিন জেটা জোন্সও। ঘটনাবহুল নাসেরির জীবনের পুরো চিত্রই ওঠে এসেছে সিনেমায়।
এর আগে ১৯৯৩ সালেও তাকে নিয়ে সিনেমা হয় ফ্রান্সে। নাম ছিল ‘তুম্ব দু শিল’। অসংখ্য তথ্যচিত্র ও প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে তাকে নিয়ে।
১৯৪৫ সালে ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের মসজিদে সোলেমান এলাকায় জন্ম নাসেরির। নিজের জিনিসপত্রের ট্রলি দিয়ে ঘেরা বেঞ্চে নাসেরি তার জীবন সম্পর্কে লিখে এবং বই ও সংবাদপত্র পড়ে দিন কাটাতেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বরাতে নাসেরির এই করুণ কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। ১৯৯৯ সালে শরণার্থীর মর্যাদা পেলেও ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিমানবন্দরেই ছিলেন নাসেরি। ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমাস্বত্ব থেকে পাওয়া ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার পুঁজি নিয়ে একটি হোস্টেলে থাকতেন তিনি। চার সপ্তাহ আগে আবারও বিমানবন্দরে ফিরে আসেন। যেখানে তার ১৮টি বছর কেটেছে। সেখানেই থাকতে শুরু করেন। বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা এএফপিকে জানান, অসুস্থতার জন্য তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তার।
নাসেরি কীভাবে আটকে গেলেন? : ইরানের শেষ রাজা শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ১৯৭৭ সালে ইরান থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। পালিয়ে বেলজিয়ামে গেলে সেখানে রাজনৈতিক শরণার্থী মর্যাদা পান তিনি। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে মাকে খুঁজে বের করার প্রয়াসে ব্রিটেন, জার্মানি এবং নেদারল্যান্ড ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু অভিবাসনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় কোথাও আশ্রয় মেলে না। পরে ফ্রান্সে আসেন।
সেখানে আটক করা হয় তাকে। তারপর তাকে টার্মিনাল টু-এফ বিল্ডিংয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, যেখানে তিনি বিমানবন্দরের কর্মচারীদের খাবার এবং ওষুধের ওপর নির্ভর করে নিজের স্যুটকেসটা নিয়ে সেখানেই থেকে যান।
১৯৯২ সালে একটি ফরাসি আদালত রায় দেন যে, তাকে বিমানবন্দর থেকে বহিষ্কার করা যাবে না, কিন্তু দেশেও ঢুকতে দেওয়া হবে না। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম উভয়েই নাসেরিকে বসবাসের প্রস্তাব দেয়, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।