সোহাগপুর গণহত্যা দিবস: বঙ্গবন্ধু তাদের প্রথম স্বীকৃতি প্রদান ও নগদ অর্থ পাঠিয়েছিলেন

সোহাগপুর গণহত্যা দিবস: বঙ্গবন্ধু তাদের প্রথম স্বীকৃতি প্রদান ও নগদ অর্থ পাঠিয়েছিলেন

দেশজুড়ে

জুলাই ২৫, ২০২৩ ১১:১২ অপরাহ্ণ

মাহফুজুর রহমান সোহাগ, নালিতাবাড়ী (শেরপুর)

২৫ জুলাই সোহাগপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে পাকিস্থানী হায়েনার দল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষ মানুষকে নির্মম ভাবে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। সেদিন প্রত্যেক্ষদশীর্র অনেকের চোখে বীরদর্পে মানুষ খুনের খেলায় মাতোয়ারা উচ্ছাসিত পাকিস্থানিরা উন্মুক্ত নৃত্য করেছিল বলে জানা যায়। সেদিনের সেই হত্যাকান্ডে সকল পুরুষ মানুষকে একদিনে হত্যা করা হয়। এজন্য গ্রামবাসী এই গ্রামের নামকরন করে ‘সোহাগপুর বিধবা পল্লী’ বা বীর কন্যা পল্লী।

সে দিনের সেই স্বজনহারা মানুষজনের গগণ বিদারী কান্না চিৎকারে সোহাগপুর গ্রামের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। আর সেদিনের এই নির্মম ঘটনার সংবাদ শুনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ব্যাথিত হয়েছিলেন। তাদের দুঃখে মমার্হত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পরবতীর্ সময়ে তাদের অনুদান, নগদ অর্থ সাহায্য পাঠিয়েছিলেন। সেই থেকে আজও সোহাগপুরের স্বামীহারা বিধবাদের কান্নার শেষ নেই! নানা অসুখে বিসুখে আজ তাদের অনেকেই নেই। কিন্তু সোহাগপুর এই গ্রামটি এখন একটি মুক্তিযোদ্ধের এতিহ্যগত ইতিহাস।

সোহাগপুর গণহত্যা দিবস: বঙ্গবন্ধু তাদের প্রথম স্বীকৃতি প্রদান ও নগদ অর্থ পাঠিয়েছিলেন

মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ও এলাকাবাসীর সুত্রে জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় ১৫০ জনের পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী সোহাগপুর গ্রামের প্রফুল্লের দিঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। হায়েনার দল অর্ধদিন ব্যাপী তান্ডব চালিয়ে খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের আশ্রয়দাতাদের। এ সময় প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এগিয়ে যায় আলী হোসেন ও জমির আলী, কিন্তু বেশী দুর এগুতে পারেনি। এক রাজাকার গুলি করে দু’জনকেই হত্যা করে। এরপর শুরু হয় নারকীয় হত্যাকান্ডের তান্ডব। মাঠে কর্মরত রমেন রিছিল, চটপাথাং ও সিরিল গাব্রিয়েল নামে তিন গারো আদিবাসী, তাদের কে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। তারপর একে একে হত্যা করে আনসার আলী, লতিফ মিয়া, ছফর উদ্দিন, শহর আলী, হযরত আলী, রিয়াজ আহমেদ, রহম আলী, সাহেব আলী, বাবর আলী, উমেদ আলী, আছমত আলী, মহেজ উদ্দিন, সিরাজ আলী, পিতা—পুত্র আবুল হোসেন সহ প্রায় ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষ মানুষকে।

যা ঘটেছিল: ২৫ জুলাই সকাল ৭টা। গ্রামের মানুষ লাঙ্গল জোয়াল নিয়ে রোপা আমন ধানের ক্ষেত লাগানোর জন্য মাঠে যাচ্ছিল। কেউ কেউ কাজ করছিল বাড়িতেই। সিরাজ আলী বসেছিল ক্ষেতের আইলে হঠাৎ গুলির শব্দে চমকে উঠে। তাকিয়ে দেখে বিলের ভেতর থেকে এগিয়ে আসছে ঘাতক রূপি হানাদার বাহিনী। ভয়ে সবাই দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইলেও হাসান আলী বলেন, তোমরা যার যার কাজ কর দৌড়ালে বরং গুলি করবে। কথা শেষ হতে না হতেই মুহুের্তই হানাদার বাহিনী কিশোর সিরাজ আলী ছাড়া সবাইকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। সে দিন লাশ হলো সবাই। রক্তে লাল হলো আমন ধানের ক্ষেত। আস্তে আস্তে সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চির নিদ্রায় শায়িত হয় সোহাগপুর গ্রামের মাটিতে।

বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়, ৫টি গুলি লাগার পরও মুমূর্ষ অবস্থায় মাটিতে পরেছিল রহম আলীর ছেলে সিরাজুল ও নাম নাজানা অপর একজন। তাদের গুংগানী থামছে না দেখে নির্দয় হানাদার বাহিনীর একজন ধারালো বেয়নেট আমুল বসিয়ে দিল তাদের মাথার উপর। চিরতরে থেমে গেল তার আর্তনাদ। ভীত শমসের আলী ও ছেলে হযরত আলী মাঠ থেকে দৌড়ে এসে ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ঘরে। হানাদার বাহিনী তাদেরকে ঘর থেকে আনতে গেলে স্ত্রী লাকজান বেগম হানাদার বাহিনীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে স্বামী সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চায়। লাকজান বেগম কে পাকবাহিনী পায়ের বুট দিয়ে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে শমসের আলীকে ধরে আনে। ভয়ে কাপছিল সারাদেহ! স্ত্রীর সামনেই গুলি করে ঝাঝরা করে দিল শমসের আলীর দেহ। একই ভাবে হত্যা করা হল তার ছেলেকেও। এভাবে সোহাগপুর গ্রামের সকল পুরুষ মানুষকে একদিনে হত্যা করা হয়। পরবর্তী থেকে এ গ্রামের নাম হয় ‘সোহাগপুর বিধবা পল্লী’। এখানে কলাপাতা, ছেড়া শাড়ী আর মশারী দিয়ে কাফন পড়িয়ে ৪/৫ টি করে লাশ এক একটি কবরে দাফন করা হয়েছিল। আবার কোন কোন কবরে ৭/৮টি করে লাশও এক সাথে কবর দেওয়া হয়েছিল। এ নারকীয় হত্যাকান্ডের জীবন্ত স্বাক্ষী রয়েছেন অনেকেই। সময়ের পাখায় ভর করে বছর ঘুরে আসে ঠিকই। আবার সামনে চলে আসে পেছনে ফেলে আসা স্মৃতি।

বর্তমানে ২২ জন বিধবা বেঁচে আছেন। এর মধ্যে ১৪ জন বিধবাকে বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ৩ জন বীরাাঙ্গনা মারা গেছেন। জীবিত আছেন বীরঙ্গনা ১১ জনসহ ২২ জন বিধবা। আলবদর রাজাকারদের বিচার হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিধবাদের ভাগ্য বদল হয়েছে। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সোহাগপুর গ্রামে। ইতো মধ্যেই ২৯ বিধবাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ লাখ টাকা মূল্যের একটি করে পাকাবাড়ি উপহার দিয়েছেন। বিধবাপল্লীতে যাওয়ার জন্য পাকাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রামের পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। কাকরকান্দির বরুয়াজানী গ্রামে শহীদদের স্মরণে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজ’ স্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও জেলা পুলিশ বিভাগের সদস্যরা তাদের বিধবাদের জমি ক্রয় করে দিয়েছেন। চিহ্নিত করা হয়েছে শহীদদের গণকবর। আর স্মৃতিকে স্মরনীয় করে রাখতে আরো নির্মাণ করা হয়েছে ‘সৌরজায়া’ নামে স্মৃতি সৌধ। দিবসটি পালন উপলক্ষে মঙ্গলবার ২৫ জুলাই সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে আলোচনা সভা, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *