রিজার্ভ চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে ইতিবাচক অগ্রগতি

রিজার্ভ চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে ইতিবাচক অগ্রগতি

জাতীয় স্লাইড

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪ ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় করা মামলার তদন্ত আট বছরেও শেষ হয়নি। এখনো উদ্ধার হয়নি চুরি হওয়া ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরির অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য সমঝোতার পথও থমকে গেছে। রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) তেমন সাড়া না দেওয়ায় অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া কার্যত স্থবির হয়ে গেছে।

তবু তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খুব শিগগির এ বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতির আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাইবার চুরি। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়।

অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়।
সেখান থেকে অন্তত ৮১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ম্যানিলাভিত্তিক আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এরপর সেখান থেকে ফিলিপাইনের ক্যাসিনোগুলোতে ওই অর্থ ব্যয় হয়। পরে বিভিন্ন সময় এক কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়।

কিন্তু এখনো ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনার ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে যে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সেই মামলায় আদালতের বাইরে সমঝোতার জন্য বিবাদীদের সুযোগ দিয়েছেন নিউ ইয়র্ক সুপ্রিম কোর্ট।

এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সর্বশেষ ধার্য তারিখ ৩১ ডিসেম্বর হলেও তদন্ত সংস্থা সিআইডি প্রতিবেদন দাখিল না করায় আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছেন আদালত।

এ নিয়ে ৭৫ বারের মতো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় পেল পুলিশের বিশেষায়িত এ বিভাগ। জানতে চাইলে সিআইডি কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, সামনের দিনটিতে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আজাদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। এ ঘটনায় দেশের বাইরের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। চুরি হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় করা একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে একাধিকবার ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় গিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের দুজন এবং সিআইডির আরো দুজন কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসির সঙ্গে দেশটির একজন মন্ত্রীর এ বিষয়ে বৈঠক হয়।

রিজার্ভ চুরি নিয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন সমঝোতার ব্যাপারটা কিছুটা স্থগিত আছে। কারণ মামলায় জড়িত একজন ব্যক্তি সহযোগিতা করছেন না। তবে আমরা চেষ্টা করছি এটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য। অন্য পক্ষরাও আছে, তাদের সঙ্গেও আলোচনা হচ্ছে।’

মামলার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই আইনজীবী বলেন, ‘মামলা চলছে নিউ ইয়র্কে। ওখানে আমাদের জুরিসডিকশন আমরা পেয়েছি। কোর্ট এখতিয়ার গ্রহণ করেছেন। সে জন্য আমরা এখন ডিসকভারি স্টেজে আছি। আমাদের হাতে যা কাগজ আছে, সেটাতে আমরা আশাবাদী। আমরা আমাদের কেস প্রমাণ করতে পারব। অন্য পক্ষ এখনো সব কাগজ দেয়নি। তাদের চাপে রেখেছি।’

সিআইডির প্রতিবেদন জমায় দেরিতে এই মামলায় কোনো প্রভাব পড়বে কি না, জানতে চাইলে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, ‘আমরা শুনেছি সিআইডির রিপোর্ট মোটামুটি প্রস্তুত। আশা করছি, শিগগিরই এটা কোর্টে দাখিল করা হবে। সেই রিপোর্ট এই মামলায় সহায়ক হবে। অন্য পক্ষ সব সময় বলে আসছে যে এটা আমরা ইচ্ছা করে আটকে রেখেছি। সিআইডি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে তাদের যে সময় লাগবে, সে সময় তো নেবেই। তারা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করবে এটাই আমরা চাই। সে রিপোর্ট আমরা আশা করি, শিগগিরই সেটা কোর্টে দাখিল করা হবে।’

মামলার ট্রায়াল প্রক্রিয়া শুরু হবে

বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির মামলা বাতিলে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক, কিং অংসহ ১৮ ব্যক্তি যে দুটি আবেদন করেছিলেন, গত বছরের ১৩ জানুয়ারি আদালত তা খারিজ করে দিয়ে অভিযুক্তদের জবাব দিতে এবং মধ্যস্থতারও নির্দেশ দিয়েছেন।

আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, ‘আমরা তাদের আইনজীবীকে একটি চিঠি পাঠিয়েছি, কিন্তু এখনো উত্তর পাইনি। তারা যদি এই সময়ের মধ্যে উত্তর পাঠায়, তাহলে আলোচনা হবে। আর তারা যদি কোনো উত্তর না দেয়, তাহলে মামলার ট্রায়ালের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। আমরা ওদের কাছে ডিসক্লোজার (তথ্যবিনিময়) চাইব, আমাদের ডিসক্লোজার দেব। এরপর শুনানির জন্য প্রস্তুতি নেব।’

যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মামলার নিয়ম অনুযায়ী, আইনগত প্রক্রিয়া শুরুর অংশ হিসেবে উভয় পক্ষ একে অন্যের কাছে মামলাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য বা কাগজপত্র চাইতে পারে। সাধারণত দুই পক্ষের কাছে যেসব নথিপত্র আছে, সেগুলো বিনিময় করতে হয়। এসব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলার আইনগত কার্যক্রম শুরু হবে। অনেক সময় কোনো কোনো পক্ষ বা ব্যক্তি তথ্য দিতে না-ও চাইতে পারে, কিন্তু তার ব্যাখ্যা থাকতে হবে।

হ্যাকার গ্রুপটি এখনো সক্রিয় : জাতিসংঘ

বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরি করা হ্যাকার গ্রুপটি এখনো সক্রিয় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে রিজার্ভ চুরি করা উত্তর কোরিয়ার লাজারাস হ্যাকার গ্রুপ এবং টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত এর সহযোগী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চক্রটি এখনো সক্রিয় রয়েছে। পুরো চক্র এখন আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকিং নেটওয়ার্কগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে অর্জিত সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।

গত ১৫ জানুয়ারি ব্যাংকক পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা পাচারের অর্থ এবং অবৈধ আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকিং নেটওয়ার্কগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতারক ও মাদক পাচারকারীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করছে। ক্যাসিনো ও ক্রিপ্টো কারেন্সি বিনিময়ের মাধ্যমগুলো এখন এ চক্রের অপরাধ সংঘটনের মূল স্থান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

প্রতিবেদনে ফিলিপাইনের লাইসেন্সকৃত ক্যাসিনো ও জাংকেট অপারেটরদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ২০১৬ সালে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাইবার আক্রমণ করে চুরি করা প্রায় ৮১ মিলিয়ন ডলার পাচারে সহায়তা করেছিল। এই অর্থ চুরির জন্য লাজারাস গ্রুপকে দায়ী করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে জাতিসংঘের মাদকদ্রব্য ও অপরাধ কার্যালয় (ইউএনওডিসি) বিশদ বিবরণ না দিয়ে জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার লাজারাস গ্রুপসহ হ্যাকাররা মেকং এলাকায় অর্থাৎ থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস ও কম্বোডিয়ায় এই ধরনের ভাগাভাগির বেশ কয়েকটি নজির দেখা গেছে। ঘটনা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ও ব্লকচেইন ডাটা বিশ্লেষণ করে তাদের কার্যকলাপ শনাক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদক পাচার এবং সাইবার প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থপাচার ও আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকিং অপারেশনের জন্য জাংকেট সেক্টরগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *