মোদির পর বিজেপির নেতৃত্বে কে আসছেন?

মোদির পর বিজেপির নেতৃত্বে কে আসছেন?

আন্তর্জাতিক

মে ২৬, ২০২৪ ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনৌতে ওই রাজ্যের রাজসিক বিধানসভা ভবনের ঠিক উল্টোদিকেই রাজ্যে বিজেপির প্রধান দফতর। বিজেপি অফিস থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তাটা পেরোলেই বিধানসভার প্রবেশপথ, যদিও এখনকার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ খুব কমই দলের কার্যালয়ে আসেন।

ভোটের সময়ে বিজেপি অফিসে যথারীতি ব্যস্ততা চরমে, পাশাপাশি মিডিয়ার কর্মীদের আপ্যায়নেও এলাহি আয়োজন। লখনৌর ‘তেহজিব’ বা সংস্কৃতিতে অতিথিপরায়ণতার খুব কদর, দলের কার্যালয়ে মেহমানদারিও একেবারে দেখবার মতো!

গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের জন্য অফিস প্রাঙ্গণের ভেতরেই বিশাল এয়ারকন্ডিশন্ড তাঁবু বসিয়ে তৈরি হয়েছে অস্থায়ী মিডিয়া সেন্টার, যেখানে বসে অন্তত শ’পাঁচেক সাংবাদিক একসঙ্গে কাজ করতে পারবেন। চা-কফি-লাচ্চির জোগানও অবিরাম।

এর মধ্যেই হাসিমুখে ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা বাইরে থেকে আসা সাংবাদিকদের সঙ্গে খোশগল্প করে যাচ্ছেন। তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন ক্লান্তিহীনভাবে, রাজ্য রাজনীতির নানা জটিল অঙ্ক বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদের মতো করে।

এই ‘অফ-দ্য-রেকর্ড’ আর খোলাখুলি আলোচনাতেও একটা প্রসঙ্গ থাকে, যেটার অবতারণা হলেই বিজেপি নেতারা স্পষ্টতই অস্বস্তিতে পড়ে যান। অতিথি সাংবাদিককে হাত জোড় করে অনুরোধ জানান, ও সব কথা থাক না!

এই প্রসঙ্গটা আর কিছুই না – প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পর কে? সোজা কথায়, দলে তার ‘সাকসেসন প্ল্যান’টা কী?

লখনৌ বা এমন কী দিল্লিতেও বিজেপি নেতৃত্ব এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে বিব্রত বোধ করেন ঠিকই, কিন্তু এবারে ভরা নির্বাচনী মৌসুমেই ইস্যুটা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন আম আদমি পার্টির নেতা তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে ক’দিন আগে তার প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই কেজরিওয়াল মনে করিয়ে দিয়েছেন, আগামী বছরেই কিন্তু নরেন্দ্র মোদি পঁচাত্তরে পা রাখবেন – যেটা অলিখিতভাবে তার নিজেরই বেঁধে দেওয়া রাজনৈতিক অবসরের বয়স।

কেজরিওয়াল তাই প্রশ্ন তুলেছেন, আগামী বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তো মোদিজিকেও (তার নিজের করা নিয়ম অনুযায়ী) অবসরে যেতে হবে। তাহলে তার পর কে?

মোদি সামনের বছর অবসরে গেলে মন্ত্রিসভায় অলিখিত দু’নম্বর অমিত শাহ-ই দায়িত্বে আসবেন, এমনও ইঙ্গিত করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। এমন কী তৃতীয়বার মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে দু’মাসের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব থেকে যোগী আদিত্যনাথকে সরানো হবে বলেও মন্তব্য করেছেন।

বিজেপির অভ্যন্তরে ‘মোদির উত্তরাধিকারী বিতর্ক’কে উসকে দেওয়াই যে তার উদ্দেশ্য ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেটা যে বেশ সফলও হয়েছে, তা বোঝা গেছে অমিত শাহ বা রাজনাথ সিংয়ের মতো দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এর উত্তর দিতে বাধ্য হওয়ায়।

তারা দু’জনেই প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ পূর্ণ করবেন – তার মাঝপথে অবসরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু এই অবকাশে বিষয়টা নিয়ে রাজনৈতিক চর্চাও শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে – বিজেপির ভেতরে যেমন, তেমনি বাইরেও।

পঁচাত্তর পূর্ণ হলে নরেন্দ্র মোদি অবসর নিন বা না নিন, দলে তার পরে কে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্বে আসবেন সেই প্রশ্নটা এর মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।

আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ তো গত সপ্তাহে তাদের একটি নিবন্ধে সোজাসাপ্টা লিখেছে, ভারতের ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে একটি নেতৃত্বের লড়াই দানা বাঁধছে।

কিন্তু ঠিক কোন কোন নামগুলো নিয়ে এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি জল্পনা চলছে?

নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রত্যেকের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলোই বা কী?

একটা কথা অবশ্য লখনৌ প্রবলভাবে বিশ্বাস করে, নরেন্দ্র মোদির পর যিনিই বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে আসুন – তার একটা ‘উত্তরপ্রদেশ কানেকশন’ অবশ্যই থাকতে হবে।

এবং এটা শুধু ওই রাজ্যের অধিকারবোধের দাবি নয়, রাজনৈতিক বাস্তবতাও!

শেষ পর্যন্ত যা-ই ঘটুক, এই মুহুর্তে সেই নেতৃত্বের দৌড়ে কারা এগিয়ে আছেন সেটির একটি তালিকা দিয়েছে বিবিসি।

যোগী আদিত্যনাথ (বয়স ৫১)

২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে জেতার পর দল যখন মুখ্যমন্ত্রী পদে যোগী আদিত্যনাথকে বেছে নেয়, কেউ ধারণাও করতে পারেনি রাজ্যে তাকেই সরকার চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হবে। বস্তুত আদিত্যনাথ ওই নির্বাচনে নিজে লড়েনওনি।

পরের সাত বছরে বিতর্কিত এই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী নেতা এবং হিন্দুদের গোরক্ষনাথ মঠের মহন্ত (প্রধান) উত্তরপ্রদেশে বিজেপির এক নম্বর মুখ হিসেবেই শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি, ২০২২র নির্বাচনেও বিজেপিকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো গরিষ্ঠতা এনে দিয়েছেন – যা ওই রাজ্যের রাজনীতিতে খুবই বিরল।

‘দিল্লি মে মোদি, লখনৌ মে যোগী’ বিজেপির খুব জনপ্রিয় একটি স্লোগানেও পরিণত হয়েছে – বিজেপির কথিত ‘ডাবল ইঞ্জিনে’র (অর্থাৎ কেন্দ্রে ও রাজ্যে যখন একই দলের সরকার) আদর্শ মডেল হিসেবেও তুলে ধরা হচ্ছে উত্তরপ্রদেশকে।

বলা হতে থাকে, মোদি-যোগীর এই ‘অসাধারণ জুটি’ই বিজেপির সাফল্যের সেরা রেসিপি। এবারের ভোটেও রাজ্যে সব ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টারে মোদির ঠিক পরেই দেখা যাচ্ছে যোগীর ছবি, যদিও একটু ছোট সাইজে।

গত দু’তিন বছর ধরে যোগীর সমর্থকরা ইতিউতি এ কথাও বলতে শুরু করেছেন, “মোদিজির পর দলের হাল ধরার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি অবশ্যই যোগীজি!”

বস্তুত প্রশাসনে এক ধরনের উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও একই সঙ্গে তীব্র মুসলিম-বিরোধী পথ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বিজেপির ‘কোর ভোটব্যাঙ্কে’র কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বাড়াতে পেরেছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের বাড়িঘর বা দোকান ভেঙেছে যোগীর বুলডোজার, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজ্যের প্রায় সব বুচারহাউসও (কসাইখানা) তিনি বন্ধ করে ছেড়েছেন।

তার আমলেই হেফাজতে রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে আতিক আহমেদ বা মুখতার আনসারির মতো মাফিয়া ডনদের। আর এই সব পদক্ষেপের প্রায় সবই নেওয়া হয়েছে বেছে বেছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে।

তবে তা-ই বলে মোদির উত্তরসূরী হিসেবেও তিনি নিজের নাম পাকা করে ফেলেছেন, এটা বিজেপিতেই অনেকে মানেন না।

অমিত শাহ (বয়স ৫৯)

গত ১৬ মে ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল “তিনি লোকজনকে ভয় দেখাতে ভালোবাসেন : যেভাবে মোদির ডান হাত, অমিত শাহ, ভারতকে চালান!”

ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত চল্লিশ বছর ধরে অমিত শাহ নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর, উপদেষ্টা এবং এক কথায় সব কাজের কাজী! আর এই মুহুর্তে তিনি ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিও।

নরেন্দ্র মোদি ২০১৪তে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই বিজেপির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন অমিত শাহ। দ্বিতীয় মেয়াদে মোদি তাকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ক্যাবিনেটে অঘোষিত দু’নম্বর ব্যক্তি করে নিয়ে আসেন।

অমিত শাহকে অনেকেই নরেন্দ্র মোদির ‘অল্টার ইগো’ বা বিকল্প সত্ত্বা বলেও বর্ণনা করেছেন।

রাজনাথ সিং (৭২)

নিউজট্র্যাকের সম্পাদক তথা বিজেপির রাজনীতি গুলে খাওয়া যোগেশ মিশ্র কিন্তু মোদির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে তৃতীয় আর একটি নামও দেখছেন – সেটি রাজনাথ সিংয়ের।

রাজনাথ এই মুহুর্তে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মোদির প্রথম মেয়াদে ছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারেও তিনি ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন – যে অভিজ্ঞতা আজকের বিজেপিতে প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে আর কারওরই নেই।

রাজনাথ সিং লখনৌ আসন থেকে নির্বাচিত বহু বছরের এমপি, বিজেপির সাবেক সভাপতিও বটে।

নরেন্দ্র মোদির পর যিনিই বিজেপির হাল ধরুন, তার নাম চূড়ান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের যে খুব বড় ভূমিকা থাকবে তা নিয়ে অবশ্য লখনৌর বিজেপি দফতরে কারওরই এতটুকুও সংশয় নেই। শহরের সিনিয়র সাংবাদিকরাও এই একটা প্রশ্নে সবাই একমত।

আসলে উত্তরপ্রদেশেই আছে ভারতের যে কোনও রাজ্যের চেয়ে বেশি লোকসভা আসন – ৮০টি। এই রাজ্যে না-জিততে পারলে দেশের ক্ষমতায় আসা যে কার্যত অসম্ভব, এটাও অতীতে বারবার দেখা গেছে।

বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ‘ডিলিমিটেশন’ বা আসন পুনর্বিন্যাস করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে, সেটা হলে উত্তরপ্রদেশের লোকসভা আসনের সংখ্যা অবধারিতভাবে আরও বাড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *