প্রশ্নটা আওয়ামী লীগ করুক

প্রশ্নটা আওয়ামী লীগ করুক

ফিচার

অক্টোবর ৯, ২০২২ ৭:৫০ অপরাহ্ণ

আয়শা এরিন

কর্তৃত্বমূলক জাতীয়তাবাদ। শাসনরীতির এমন রূপকে ফ্যাসিবাদ বলার চেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রকে দংশন করে সরকার এমন চেহারা প্রকাশ করে, দুর্বল গোষ্ঠী তা বলতে থাকে। অভিযোগ আর অনুযোগ করে তাঁরা বলতে চায়, দেখুন আমরা কত অসহায়!

অসহায় হওয়ার সুর তাই সব দেশে প্রায়শই ধ্বনিত হয়। গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রের গলিতে বাজতে থাকে সাম্যের গান। গান গ্রহণযোগ্যতা পেলে পুরোনো দুর্বলেরাও একদিন বীরের বেশে বলতে থাকে, আমরা ক্ষমতায় অবশেষে চলে আসতে পেরেছি।

ক্ষমতা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় শাসক শ্রেণির নানাবিধ অনুশীলন ও কর্ম প্রকৃতি। বেশ কয়েক বছর পর একদিন জনশ্রেণি পুনরায় বলতে থাকে, ওরাও সবল হয়ে গেছে। যাদেরকে একযুগ বা এর চেয়েও কম সময় আগে ফ্যাসিবাদী বলা হচ্ছিল, তাঁরাই আজ খুব অসহায়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে সারাবিশ্বে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক বলয় তৈরি করে একে অপরকে ফ্যাসিবাদী বলার হাস্যকর চেষ্টাকে জনশ্রেণি গভীরভাবে নিচ্ছেও। ফলশ্রুতিতে মানুষ ব্যালট বাক্সে তাঁর ভোটাধিকার প্রদান করাটাকে ফলাফল নির্ধারণের হাতিয়ার হিসাবে ধরে।

প্রশ্ন এখন দুটি। এক, মানুষ কেন তাঁর ভোটাধিকার চায়? দুই, নিজেদের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা কায়েমে বিপ্লব করার মানসে কেন থাকা হচ্ছে না?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজনীতি করার অধিকার অর্জন করার পর্যায়ে কারা থাকতে পেরেছেন? এটিও একটি তৃতীয় জিজ্ঞাসা হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নিবন্ধিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে তালিকাটি খুবই ছোট হবে।

আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ খোলস বদলাতে বদলাতে তাও কোনোমতে টিকে গেছে। প্রথমত, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল হিসাবে। শেষত, অতি অবশ্যই শেখ হাসিনার মত নেতৃত্বের দূরদৃষ্টিগত উপলক্ষ্য দৃশ্যমান হওয়ায়। আওয়ামী লীগ তাই আদর্শচ্যুত হয়েও শেখ হাসিনার মত নেতার দক্ষতায় সেই অর্থবহ প্রশ্নটি মুখ থুবড়ে পড়ছে। অন্যদের মধ্যে বাকি ৩৮টি দলের অবস্থা তথৈবচ। সুগভীর পর্যালোচনায় প্রত্যেকটি দলের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে দল বিলুপ্ত করা উচিত।

একটি রাজনৈতিক দলও শক্ত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। অর্থাভাবে কয়েকটি রাজনৈতিক দল স্বপ্ন দেখিয়েও একান্ন বছরের বাংলাদেশে এখন অংশীদারিত্বের রাজনীতি করে বলে এই বেশ ভালো আছি, জাতীয় সংসদেও তো আছি! এই তালিকায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ( মোজাফফর) ন্যাপ ( ভাসানি), জাসদ-এর মত রাজনৈতিক দল রয়েছে। বাকি দলগুলোর রাজনৈতিক ভিত্তি ঐতিহাসিকতার সূত্রপাত থেকে বাহিত নয়।

পাঠকশ্রেণি এখন বিরক্ত হবেন। বলবেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে (এরশাদ) রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেবেন না? আসলে কী দেওয়া যায়?

ফলত, দেওয়া যায় না। দুটো দলই বুর্জুয়াশ্রেণির স্বার্থ বাঁচিয়ে রাজনীতিকে প্রতিনিধিত্ব করে। জন্ম হয়েছে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত সিংহাসন থেকে, যেখানে দুই রাজা জিয়া ও এরশাদের পরনেই বস্ত্র ছিল না। উভয়েই নগ্ন ছিলেন! ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাঁরা দিবানিশি যা খুশি করেছেন। অন্যদিকে, ফ্যাসিবাদের গণমুখী ইতিবাচক গুণগুলোর ধারক হয়ে অবশ্যি তাঁরা বাংলাদেশে টিকে গেছে। কিন্তু, কেন টিকে রয়েছে?

উত্তর দিতে হলে আলোচ্য ধারাভাষ্যের দুইটি প্রশ্নের দিকে পুনরায় মনোযোগী হতে হবে। আধ্যাত্মবাদের সড়কে মানবপ্রকৃতি জানিয়ে দিচ্ছে, তোমার মধ্যেই ঈশ্বর ও তাঁর বিপক্ষ শক্তি রয়েছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ হলো লাল সবুজের বাংলায় প্রকৃতির ইতিবাচক শক্তির মত। কিন্তু, আধ্যাত্মিক অপশক্তি তো বসে থাকতে পারে না। তাই তাঁরা একবার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ব্র্যান্ডিং করে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরি করল। একপর্যায়ে জিয়াউর রহমানের মত অপদার্থের হাতে দেশের ক্ষমতা ধরা দিল। কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তা নেওয়ার চেষ্টা করতে তিনি তৎপর ছিলেন।

ভৌতিক প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে জিয়ার শাসনের আদ্যপান্ত জানান দেয়, তিনি খুনে হাসিতে মেতে যেয়ে অপশক্তির আনুষ্ঠানিক পথিকৃৎ হিসাবেই নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। প্রকৃতিও অবশ্য বলল, তোমাকে থামতে হচ্ছে। এই থামার কথা বলে উধাও হতে যেয়ে এরশাদ নামের এক ব্যক্তি নয় বছরের দেশ পরিচালনা করলেন। দিনশেষে প্রকৃতির ঘোষণা, তোমাদের ২০ বছর পার হয়ে গেছে। অথচ, তোমার দেশের মানুষগুলো রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেনি। তাঁরা ভোট দিতে চায়, কিন্তু ভোট প্রয়োগ করার জন্যও যে যোগ্যতা থাকার দরকার তা তাঁরা জানে না, বোঝে না। সঙ্গত কারণে তাঁরা ভোট দিতে চায় গোলাম আজম-জিয়াদের উত্তরসূরীদের। হলোও তাই। একজন প্রাইমারি শিক্ষিকা হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও বেগম খালেদা জিয়া কপোলে আঙ্গুল তুলে ঘাড় কাত করে বললেন, আমি এখন ক্ষমতায়!

সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় যেমন প্রজা তেমন রাজা হয়ে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। লিলিপুট জনগোষ্ঠির জন্য লিলিপুট প্রধানমন্ত্রী!

উত্তর তাই দেওয়াই যায়। কেন বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে হবে? তাঁরা এমন সুযোগ পেলে স্বাধীনতা কী জানতে চায় না। তারা শাসন কী, শোষণ কী বুঝতে চায় না। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে আমলে নেয় না। তাঁরা জাতীয়তা কী, জাতীয়তাবাদ কী, সংবিধান কী, পড়ে বুঝে শিক্ষিত হওয়ার ঝুঁকি নেয় না। তাঁরা রাজস্ব আয়ের খাতগুলো কী কী, জানতে চায় না। তাঁরা দেশের প্রত্যেকটি রাজনীতি দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা সম্পর্কে অবহিত হতে চায় না। তাঁরা পররাষ্ট্রনীতি কী, উন্নয়ন কী- কিছুই শুনতে চায় না। তাঁরা একবার বলবে, দেশ চলবে মতিউর রহমান কিংবা সাকা চৌধুরীর উত্তরসূরীদের কথায়। একবার বলবে, বাবুনগরীর কথায়। এখন আবার বলছে, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে সেই অশিক্ষিত খালেদা জিয়ার কথায়। কাজেই বঙ্গবন্ধুকে ঠেকাও রাজনীতির মাধ্যমে যে যাত্রা প্রকৃতির নেতিবাচক শক্তিকে ধারণ করে তারা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই মন্দ এক্সপ্রেস চলছে। মনকে সাম্প্রদায়িক রেখে আজ তাঁরা হাসিনাকে ঠেকাওয়ের রাজনীতি করে। আবার দেশের জনগণের একটি অংশ তালও মেলায়। এই তাল মেলানোর জন্য বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে ভোটতন্ত্র চালু রাখার সবিশেষ যুক্তি আছে কিনা, উত্তর মেলানোর পথ খুঁজে নিন তবে।

বাংলাদেশকে এখন নতুন করেই শুরু করতে হবে। আওয়ামী লীগের সাথে আরেকটি রাজনৈতিক দল লড়াই করতে উদ্যত হোক। যারা নিজেদের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা কায়েমে আগে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব করবে। অতঃপর শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্র হোক কিংবা উন্নত সমাজতন্ত্র- দুইটি দলের বা বলয়ের কার্যকর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সুশাসক হিসাবে তাঁরা তাদের রাজনীতি তথা রাজনৈতিক দলকে পরিচিত করাক। অর্থাৎ সংলাপের মধ্য দিয়ে দেশের বিদগ্ধশ্রেণি তৃতীয় পক্ষ হয়ে তেমন কাজটি করে দিক।

একান্ন বছরের বাংলাদেশে দুই একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কথায় কথায় বলা হচ্ছে যে, আমাদের রাজনীতির শেকড় অনেক গভীরে, আসলে শেকড় নয়, তা আগাছার মত করে। যা পরিষ্কার করার দরকার। স্পষ্টত বলা দরকার যে, আওয়ামী লীগই আহবান করে বলুক যে, আমরা নিজেদেরকে আরো পরিপাটি করতে চাই। আর আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে একটা স্বর্গীয় প্রতিপক্ষ আসুক। আমরা স্বর্গীয়, তাঁরাও স্বর্গীয় হোক। এরপর তারা বলুক যে, দেশের মানুষকে সামাজিক- সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করব।

আওয়ামী লীগ তাদের আসন্ন জাতীয় সম্মেলন থেকেই শুরু করতে পারে। তাঁরা শেখ হাসিনার জন্য একজন যোগ্য সেনাপতি নির্বাচন করুক। ভালো সাধারণ সম্পাদক! আপাত দৃষ্টিতে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকে তেমন সত্তা হিসাবে দেখা হচ্ছে, খুব সম্ভবত। অতঃপর, তাঁরা একটি ক্রেডিবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আশা করুক। নতুন একটা রাজনৈতিক শক্তির জন্ম তাঁরাই প্রত্যাশা করুক। আর বিএনপির মত করে যে সকল রাজনৈতিক অপশক্তি আছে, দেশবাসী বলব না, আওয়ামী লীগ তাদের নিজেদের কর্মীদেরকে নিয়ে আপাতভাবে মোকাবিলা করুক। জনগণকেও আহবান করে বলুক, এদের কি কোনো অধিকার আছে বাংলাদেশে রাজনীতি করার? প্রশ্নটা আওয়ামী লীগ করুক।

আয়শা এরিন : সাংবাদিক, গবেষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *