প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে দেশের চাকরির বাজার

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে দেশের চাকরির বাজার

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্লাইড

ডিসেম্বর ৬, ২০২৩ ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

গত এক দশক আগেও বাংলাদেশের চাকরি বাজার যেমন ছিল, এক দশক পরে এসে বর্তমানে সেক্ষেত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এর মূলে প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া।

এক সময় দেশের চাকরির বাজারে ছিল করপোরেট খাতের গৎবাঁধা কাজ কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নথিভিত্তিক নটা-পাঁচটার চাকরি। সেখানে এখন শুধু প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে গোটা চেহারাটাই বদলে গেছে।

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ কর্মজীবী সরাসরি আইটি খাতে চাকরি করছেন। গতানুগতিক চাকরির বাইরেও এ খাতকে কেন্দ্র করে দেশে ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সারের সমন্বয়ে গড়ে ওঠেছে কর্মসংস্থানের বড় একটি বাজার।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আইটি খাত থেকে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি আয় এসেছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এ আয় ছিল ৫২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। মূলত সফটওয়্যার রফতানি থেকে শুরু করে আইটি খাতে বহুমুখী কাজের কারণে আয়ের দিক থেকে দেশের এ খাতে লেগেছে ইতিবাচক হাওয়া।

রফতানি আয় ছাড়াও দেশের রেমিট্যান্সে আইটি খাতের ফ্রিল্যান্সাররা বড় রকমের ভূমিকা পালন করছেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশের মোট ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সারের হাত ধরে রেমিট্যান্সে যোগ হচ্ছে ১০০ কোটি ডলার।

দিনকে দিন তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং। অনেকে ছাত্রজীবনেই শুরু করেছেন ফ্রিল্যান্সিং; অনেকে আবার পড়াশোনা শেষ করে যুক্ত হচ্ছেন এ পেশার সঙ্গে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের সাবেক ছাত্র নাদিম মাহমুদ একজন ফ্রিল্যান্সার। তরুণদের ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে নাদিম বলেন, দিনকে দিন এটি লাভজনক পেশায় পরিণত হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা মূলত স্বাধীনচেতা হয়ে থাকে। আর্থিক নিরাপত্তার পাশাপাশি স্বাধীনতার এ স্বাদ ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব।

নাদিম বলেন, পড়াশোনা শেষে তিনি একটি আইটি ফার্মে ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। চাকরির গৎবাঁধা নিয়ম ছেড়ে পরবর্তীতে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। এখন ফ্রিল্যান্সিং করে তিনি মাসে দেড় লাখ টাকার ওপরে আয় করেন বলে জানান।

আরেক ফ্রিল্যান্সার সাফওয়ান হাবিব বলেন, শুরুতে অনেকেই এটিকে চাকরি বা আয়ের উপযুক্ত মাধ্যম বলে মেনে নিতে নারাজ ছিল। পরিবারের কথা ছিল, এটা কোনো চাকরি হতে পারে না। দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে নটা-পাঁচটা চাকরির বাইরে আর কোনো চাকরি নেই। তবে বিগত কয়েক দশকে চাকরির এ চিত্র অনেকখানি বদলে গেছে।

শুধু ফ্রিল্যান্সিং না, প্রযুক্তি খাতকে কেন্দ্র করে দিনকে দিন দেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ও বড় রকমের ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই গতানুগতিক চাকরির বাইরে ই-কমার্সের কল্যাণে উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। নিজেরা উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি বাকিদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পারছেন তারা।

বাংলাদেশে বিটুসি কমার্স মার্কেটের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে ই-কমার্স খাতের বাজারের আকার দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে আড়াই হাজারের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯৫ ভাগই নতুন উদ্যোক্তাদের। আইটি খাতের মাধ্যমে অনেকেই ঘরে বসে অল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন।

রিয়াদ হোসেন হাওলাদার রাজধানীর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। লেখাপড়ার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রির একটি ই-কমার্স সাইট রয়েছে তার। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রিয়াদ বলেন, ব্যবসা করার ইচ্ছা থাকলেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না ঠিক কী দিয়ে শুরু করা যায়। পরবর্তীতে এক রকমের বিনা পুঁজিতে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করি। এখন শুধু একটি ফেসবুক পেজ আর ওয়েবসাইটের অর্ডার থেকেই মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারছি।

দেশে ই-কমার্স এবং আইটি খাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে নতুন চাকরির পদ। ডিজিটাল মার্কেটিং, এসইও স্পেশালিস্ট, কপি রাইটার, গ্রাফিকস ডিজাইনারের মতো পদগুলোতে তরুণরা জায়গা করে নিতে পারছেন। অনেকে ঘরে বসে কাজ করে টাকা আয় করতে পারছেন।

এসব পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি আইটি খাত কেন্দ্রিক অনলাইন কোর্সের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে চাকরির বাজার।

এমন একটি অনলাইন কোর্সের শিক্ষক সাব্বির হোসেন বলেন, আগে আইটি বললে মানুষ শুধু প্রকৌশল বিদ্যার কথাই ভাবতো। এখন আইটি মানে অনেক কিছু। ব্যবসা-বাণিজ্য, সৃজনশীল কাজ থেকে শুরু করে অনেক রকমের পেশা তৈরি হয়েছে এ খাতকে ঘিরে। অনেকেই এ খাতে দক্ষ হতে অনলাইনের মাধ্যমে নানা ধরনের কোর্স করে দক্ষ হতে চাইছেন। এই কোর্সকে কেন্দ্র করে আবার নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।

আইটি খাতের চাকরি এখন আর আইটি ফার্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি খাতেই আইটি বিভাগে বড় রকমের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং দিনকে দিন এর চাহিদা বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশে না, দেশের বাইরে বাংলাদেশের আইটিখাত সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা সুনাম নিয়ে আসছেন।

আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের সাবেক ছাত্র ইমতিয়াজ হাসান বর্তমানে মালয়েশিয়ার একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করছেন। দেশের বাইরে বাংলাদেশের আইটিখাত সংশ্লিষ্টদের চাহিদা নিয়ে ইমতিয়াজ বলেন, দেশের বাইরে বাংলাদেশের আইটি খাতের বড় ধরনের সুনাম আছে। যারা আইটি খাতে দক্ষ তারা দেশের বাইরেও ভালো ভালো কাজ করছেন।

ইমতিয়াজ বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ল্যাবে কাজ করেও শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছে। আগে দেশের বাইরে মানুষ শুধু পড়াশোনা করতে যেত, এখন চাকরি করতেও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের দক্ষ শিক্ষার্থীরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এতে করে সাধারণ প্রবাসীদের পাশাপাশি হোয়াইট কলার প্রবাসীর সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কবছর আগেও যেখানে সিলিকন ভ্যালিতে বাংলাদেশি কোনো শিক্ষার্থীর চাকরি পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। এখন তা সাধারণ বাস্তব। প্রতি বছরই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক কিংবা স্পেসএক্সের মতো বাঘা বাঘা কোম্পানিতে চাকরি পাচ্ছে।

দেশের বাইরের চাকরি ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানীর বুকে দিনকে দিন আইটি ফার্মের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানী বড় একটি টেক হাব অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।

এর আগে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘বনানী হবে বাংলাদেশের সিলিকন ভ্যালি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, গুগলের অফিসে যে ছেলেটা কম্পিউটারের সামনে বসে আছে, আর আমাদের দেশের একটা ছেলে যে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে, দুটোই কিন্তু প্রায় একই কম্পিউটার। পার্থক্যটা হচ্ছে আমাদের দক্ষতায়। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আরও বাড়াতে হবে। প্রতিবছর বুয়েট থেকে কেউ না কেউ বাইরে গিয়ে প্রোগ্রামিংয়ে পুরস্কার নিয়ে আসছে। তাদের কতজনকে আমরা চিনি? কতজনকেও বা আমরা ধরে রাখতে পারি। এদের ধরে রাখতে পারলে দেশের প্রযুক্তিখাতে আরও বড় রকমের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে প্রধান প্রতিজ্ঞা ছিল বর্তমান বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর। ২০২২ সালে এসে বাংলাদেশের লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাত্রা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে তা অর্জন। এ লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে দেশের আইটি খাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *