নিজস্ব প্রতিবেদক
অভাবের তাড়নায় ১৩ বছরের মেয়ে জান্নাতকে রাজধানী ঢাকায় পুলিশের অতিরিক্ত উপ—কমিশনার মো. আলাউদ্দীনের বাসায় কাজ করতে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার আবুবকর। জান্নাত ৫ হাজার টাকাও পাঠিয়েছিল বাবার কাছে। কিন্তু এই সুখ কপালে সয়নি আবুবকরের। মেয়েকে কাজে পাঠানোর ৫০ দিনের মাথায় ‘উপহার পেলেন’ মেয়ের পোড়া লাশ। ১৭ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে জান্নাত মারা যায়। তার শ্বাসনালি, কণ্ঠনালিসহ শরীরের ৮৫ শতাংশ পোড়া ছিল। যার ফলে কোনো চিকিৎসা কাজে আসেনি।
শান্তিনগরে ওয়ারী জোনের অতিরিক্ত উপ—কমিশনার (এডিসি) মো. আলাউদ্দীনের বাসায় ১৬ এপ্রিল পুড়ে যায় জান্নাত। আলাউদ্দীনের পরিবার জানিয়েছে, দুপুরে গরম পানি করার সময় ওড়নায় আগুন লেগে গেলে পুড়ে যায় জান্নাত। কিন্তু কীভাবে ওই আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে, তপ্ত দুপুরে আদৌও গরম পানির দরকার ছিল কি না? ওই সময় বাসায় কার কী ভূমিকা ছিল তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
গৃহকর্মী জান্নাত আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর মামুন নামে পুলিশের এক কনস্টেবল ‘লুকোছাপা’ করে হাসপাতালে ভর্তি করেন জান্নাতকে। জান্নাতকে ভর্তি করেই মামুন হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এড়িয়ে যান গণমাধ্যমকেও। এমনকি এ বিষয়ে তিনি মুখে কুুলুপ এঁটেছেন। জান্নাতের বাবা আবুবকরের অভিযোগ, মেয়ে আগুনে পুড়ে গেলেও তাকে প্রথমে জানানো হয়নি। ঢাকায় এসে তিনি মেয়ের মরদেহ পেয়েছেন। এমনকি গণমাধ্যমে কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে ওই সময় আবু বকরকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।
মারধর করা হতো জান্নাতকে!
১৬ এপ্রিল পোড়া অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পর উপস্থিত নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জান্নাত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নার্স বলেন, ‘জান্নাতকে আইসিইউতে নেওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে। তখন জান্নাত বলেছিল, দুপুরের দিকে হাত থেকে একটি কাচের প্লেট মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায়। সে জন্য পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মোহনা মেহফুজ শুকতি তাকে ভীষণ মারধর করে। এতে কপালে প্রচণ্ডভাবে আঘাত লাগে। এরপর আমি রান্না ঘরে যাই। কীভাবে শরীরে আগুন লাগল তা বলতে পারছি না। এরপর আর কোনো তথ্য জানাতে পারেনি জান্নাত।’
ওই নার্স আরও বলেন, ‘এর আগেও তাকে মারধর করার কথা জানিয়েছিল জান্নাত। ভাত রান্না করার সময় ভাতের মাড় পরে যাওয়ায়ও একদিন বেদমভাবে প্রহার করা হয়েছে।’
পুরো শরীরে মারধরের দাগ থাকলেও পুড়ে যাওয়ার কারণে তা ঠিকমতো বোঝা যায়নি বলে জানান ওই নার্স। জান্নাত আরও জানায়, বাবা—মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও জান্নাতকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। বাসায় ফিরে যেতে চাইলেও যেতে দেওয়া হয়নি। ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হতো না। কারণে—অকারণে মারধর করতেন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মোহনা মেহফুজ শুকতি।
রাজধানীর শান্তিনগরে ১৬৫ স্কাইভিউ পার্ক সিটি ভবনের ১৬/এ বাসায় জান্নাত গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত। পরিবার নিয়ে ওই বাসায় ভাড়া থাকেন পুলিশের এডিসি মো. আলাউদ্দীন। ঘটনার দিন আলাউদ্দিন বাসায় ছিলেন না। তবে তার স্ত্রী বাসায় ছিলেন।
গোপনে হাসপাতালে ভর্তি
জান্নাত পুড়ে যাওয়ার পর ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান এক ব্যক্তি। পুলিশ কেইস ডকুমেন্টে ওই ব্যক্তির নাম নেই। কোথায় ঘটনাটি ঘটেছে তাও উল্লেখ নেই। তবে যে ব্যক্তি জান্নাতকে হাসপাতালে নিয়ে যান তার মোবাইল নম্বর লেখা রয়েছে কেইস ডকেটে। জান্নাতকে হাসপাতালে নিয়েছিলেন পুলিশ কনস্টেবল মামুন। কেইস ডকুমেন্টে উল্লেখ থাকা মোবাইল নম্বরে কল করা হলে ট্রু কলার অ্যাপে কাজী আল মামুন নাম লেখা আসে।
গত রোববার (২৩ এপ্রিল) মামুনকে মোবাইল ফোনে কল করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই তিনি বলেন, ‘আপনার যা বলার আলাউদ্দিন স্যারের কাছে বলেন। আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।’ এরপর মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) আবারও কনস্টেবল মামুনকে আবার ফোন করা হয়। জানতে চাওয়া হয় ঘটনার সময় আপনি এডিসির বাসায় ছিলেন নাকি আপনাকে ডেকে আনা হয়েছিল? জবাবে মামুন বলেন, ‘আপনি আমাকে আর কোনোদিন এ বিষয়ে ফোন করবেন না।’
দুপুর বেলা গরম পানির কী কাজ?
জান্নাত আসলেই ওইদিন দুপুরে পানি গরম করতে রান্নাঘরে গিয়েছিল নাকি অন্য কোনোভাবে আগুন লাগে সে ব্যাপারটি নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, ঘটনার দিন ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। মৌসুমী তাপপ্রবাহে চারদিক দিক কাহিল দশা। ওই অবস্থায় গরম পানি করতে গিয়ে আগুন লাগার তথ্যটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কারও শরীরে ৮৫ শতাংশ দগ্ধ হতে হলে বাচ্চাদের বেলায় অন্তত ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগুন জ্বলতে হয়। এতক্ষণেও আগুন নেভাতে না পারার বিষয়টি মর্মদায়ক।’
মুখ খুলছেন না এডিসি
ঘটনার বিষয়ে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের এডিসি আলাউদ্দিনও কোনো কথা বলছেন না। একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করেও তার সরকারি মোবাইল নম্বরে প্রথমে পাওয়া যায়নি। মেসেজ পাঠিয়েও তার সাড়া মেলেনি।
সবশেষ বুধবার (২৬ এপ্রিল) এডিসি আলাউদ্দিন কল রিসিভ করেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি অফিসে ছিলাম। গিয়ে শুনেছি গরম পানি করতে গিয়ে গায়ে আগুন ধরে যায়।’
চুলার কাছে যাওয়ার আগে নাকি তাকে মারধর করা হয়েছিল? জবাবে তিনি বলেন, ‘এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
ওইদিনের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি অফিসে আইসেন, কথা বলব।’
মানা হয়নি শ্রম আইন, গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা
জান্নাতের নিয়োগের বেলায় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি—২০১৫ মানা হয়নি। মানা হয়নি শ্রম আইন— ২০০৬। জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু বলা হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন। আর বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে ১৫ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই ১৪ বছরের মধ্যে সবাই শিশু। শিশু শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কাউকে বা শিশু শ্রমিককে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড গুড গভর্নেন্স ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজ সেলিম বলেন, ‘পুলিশের অতিরিক্ত উপ—কমিশনার মোহাম্মদ আলাউদ্দীন চাইলে প্রাপ্তবয়স্ক গৃহকর্মী নিয়োগ দিতে পারতেন। কিন্তু প্রথম শ্রেণির এই গেজেটেড কর্মকর্তা তা করেননি। তিনি আইনের লোক হয়েও একাধিক জায়গায় আইন—নীতি লঙ্ঘন করেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ১৩ বছরের এক কিশোরীকে আগুনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করেছেন।’
মোহাম্মদ আলাউদ্দিন একজন পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার। আর তার স্ত্রী মোহনা মেহেফুজ শুকতি একজন চিকিৎসক। তারা উচ্চশিক্ষিত হয়েও একজন শিশুকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং বাসার ভারী কাজ কর্ম করিয়েছেন। যারা একটি সামান্য প্লেট ভাঙার অপরাধে প্রচণ্ডভাবে মাথায় আঘাত করেছেন।
জান্নাতের মাথায় গভীর জখম
সুরতহাল প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জান্নাতের মাথায় গভীর জখম রয়েছে। এ দাগ কিসের তা বলতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কেউই। তবে জান্নাত মৃত্যুর আগে নার্সদের বলে গেছে, আগুন লাগার আগে মেঝেতে প্লেট পড়ে ভেঙে যাওয়ার অভিযোগে এডিসির স্ত্রী তাকে মারধর করেছে। ভারি কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করার কারণে তার কপালে কেটে গেছে। আর কপালের দাগের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, সেটি পুরনো দাগ ছিল। নতুন দাগ ছিল না সেটি।
১৭ এপ্রিল সোমবার রাতে পল্টন থানার কনস্টেবল রিমাকে সঙ্গে নিয়ে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন এসআই সুইটি। সুরতহালে লেখা হয়েছে, কপালের ওপরে মাথার সম্মুখভাবে ২ ইঞ্চি লম্বা ও দেড় ইঞ্চি গভীর (অনুমান) একটি কাটা দাগ আছে। মাথার ডান পাশে হালকা ফোলা আছে। কপাল, ঠোঁট, গলা পোড়া ও ঝলসানো। কাঁধে থেকে উভয় হাতের আঙুল পর্যন্ত সাদা রাউন্ড ব্যান্ডেজ। কোমরের নিচ থেকে উভয় পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সাদা ব্যান্ডেজ। মৃত্যুর আগে মেয়েটি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল কি না, তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে সুরতহালে অনুরোধ করা হয়েছে।
সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা এসআই সুইটি। ঈদের ছুটিতে গ্রামে আছেন তিনি। তিনি মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) মোবাইল ফোনে বলেন, জান্নাতের কপালে গভীর জখমের দাগ পেয়েছি। যা যা পেয়েছি সবকিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। তাছাড়া গলা থেকে পা পর্যন্ত ব্যান্ডেজ থাকায় শরীরের তেমন কোনো অংশ দেখতে পারিনি। শুধু কপালে একটি দাগ পেয়েছি সেটা লিখেছি।’
জান্নাতের বাবাকে ৫ লাখ টাকার আশ্বাস
গত কয়েকদিন ধরে জান্নাতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। জান্নাতের বাবার মোবাইল নম্বরে প্রতিদিন কয়েকবার করে কল করা হলেও ফোন রিসিভ হয়নি।সবশেষ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেওছিয়ার ইউপি মেম্বার শাহেদ মিয়া ওরফে চান মিয়া বলেন, ‘কেওছিয়া এলাকাটি অনেক বড়। আবুবকর নামে অনেকে আছে। কোন আবু বকরের মেয়ে আগুনে পুড়ে মারা গেছে তা আগে শুনিনি। তবে খোঁজ নিয়ে জানাতে পারব।’
এর কিছু সময় পর জান্নাতের বাবা আবু বকর ফোন রিসিভ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে ফোন করে ঢাকায় ডেকে নেন আলাউদ্দিন স্যার। গিয়ে জানতে পারি জান্নাত পুড়ে মারা গেছে। নানাভাবে আমাকে বোঝানো হয়। তারা আমাকে টাকা দিতে চেয়েছে। আজীবন পরিবারের ভরণ—পোষণ দিতে চেয়েছে।’
মেয়ের মৃত্যুর জন্য বিচার চাওয়া প্রসঙ্গে জান্নাতের বাবা বলেন, ‘বিচার কার কাছে চাইব। দোষ আমার কপালে। আমি গরিব মানুষ। সংসারে অভাব রয়েছে। উনি তো পুলিশ। বিচার চাওয়ার মতো টাকা—পয়সা তো নেই। আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি।’
ওই পুলিশ কর্মকর্তা টাকা দিতে চেয়েছে বলেও জানান আবু বকর। তিনি বলেন, ‘আমাকে ৫ লাখ টাকা দিতে চেয়েছে। কবে দেবে তা জানি না। আবার বলেছে, আমার পরিবারকে তিনি সারাজীবন দেখবেন।’
নগদ কোনো সহায়তা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়ের মরদেহ আনার সময় আমাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল। টাকা হাতে দিয়েছে বলেছে, এটি নাও, মেয়েকে কবর দাও।’
আবুবকর বলেন, ‘ওনারা বললেন তোমার মেয়ে চুলায় আগুন ধরাতে গিয়ে গায়ে আগুন লেগেছে। ওই সময় নাকি ম্যাডাম (এডিসির স্ত্রী) একাই ছিলেন। তিনি নাকি আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন। তার হাত, বুক, ওড়না পুড়ে গেছে। হাসপাতালে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসাও নিয়েছেন।’
জান্নাতের বাবা জানান, চার ছেলে মেয়ে তার। অভাবের সংসারে অর্থ জোগান দিতে এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় মাত্র ৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে জান্নাতকে কাজে দেই। এক মাস ২০ দিনের মাথায় মেয়ের লাশ নিয়ে আসি।’
আবু বকর বলেন, ‘আমি যখন স্যারকে ফোন দিতাম তিনি বলতেন অফিসে আছি। মেয়ে কেমন আছে জানতে চাইলে তিনি বলতেন, তোমার মেয়ে ভালো আছে।’
জব্দ হয়নি কোনো আলামতই
পুলিশ চাইলে কোনো ঘটনার তদন্তের স্বার্থে আলামত জব্দ করার এখতিয়ার রাখে। কিন্তু গৃহকর্মী জান্নাতের মৃত্যুর ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা হয়নি কোনো আলামত। এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ‘সদুত্তর’ আসেনি।
জবাবে এসআই রবীন বলেন, ‘কোনো আলামত পাইনি।’
সিআইডির ফরেনসিক বিভাগকে ঘটনাস্থলে নিয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। সিআইডির কোনো দল যায়নি। সবকিছুই পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে চলে আসবে। এ জন্য কোনো কিছু নেওয়া হয়নি।’
আগুন লাগার প্রেক্ষাপট কীভাবে পোস্ট মর্টেমে আসবে জানতে চাইলে এসআই রবীন কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
অন্য কারও বাসায় এরকম আগুনে কেউ পুড়লে বা মারা গেলে সাধারণত ওই বাসার মালিক বা মালিকের স্ত্রীকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অনেক সময় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন কিংবা ওই পরিবারের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কি না জবাবে এসআই রবীন কোনো উত্তর দেননি।
ওই বাসায় গিয়ে কী জানতে পেরেছেন জানতে চাওয়া হলে এসআই রবীন বলেন, ‘দুপুরে পানি গরম করতে গিয়েছিল জান্নাত। চুলার কাছে ওড়নায় আগুন লেগে যায়। এরপর সে পুড়ে যায়। তারপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে জান্নাতের বাবা এসে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন।’
ওইদিন তপ্ত দুপুরে গরম পানি কেন করছিল জান্নাত, তা কি জানতে চেয়েছিলেন তদন্তের সময়? জবাবে এসআই রবীন বলেন, ‘বিষয়টি জানতে চাইনি। তারা যা বলেছে, তাই নোট করেছি।’
বিচার কী হবে? যা বলছে পুলিশ
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাউদ্দিন মিয়া মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) তার কক্ষে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘জান্নাতের মৃত্যুর ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। অবশ্যই তদন্ত হবে। তবে অপমৃত্যুর মামলার ক্ষেত্রে পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
ওসির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় গৃহকর্মী আগুনে পুড়ে মারা গেল। এটির বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত পুলিশ করতে পারবে কি না— জবাবে ওসি বলেন, ‘অবশ্যই তদন্ত হবে, সঠিক তদন্ত হবে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার সহকারী পুলিশ পরিদর্শক এসআই রবীন্দ্র নাথ রবীন বলেন, ‘এই মামলার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাচ্ছে না। গত ১৯ এপ্রিল ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। এডিসির বাসায় গিয়ে বক্তব্য নিয়ে এসেছি।’
ওই বাসায় সাংবাদিক ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না
শান্তিনগরে ১৬৫ স্কাইভিউ পার্ক সিটি ভবনে সরেজমিনে তথ্য অনুসন্ধান করতে ওই বাসায় ঢুকতে চাইলে নিরাপত্তাপ্রহরীদের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। সেখানে কাউকে ঢোকা বারণ বলে নিরাপত্তাকর্মীরা জানান। এমনকি ওই বাসায় নিরাপত্তাপ্রহরীর মাধ্যমে খবর পাঠানো হলেও সেখান থেকে কোনো সহযোগিতা মেলেনি।
তবে পার্ক সিটি ভবনের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা শুনেছিলাম এখানে একজন পুড়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে পুড়ে গেছে, কার বাসায় পুড়ে গেছে। তা জানতে পারছিলাম না।’
অপর একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শুনেছি একজন গৃহকর্মী আগুনে পুড়ে গেছে। দুই—তিন ঘণ্টা ধরে এই আলোচনা চলছিল। পুড়ে যাওয়ার অন্তত ৩ ঘণ্টা পর মেয়েটিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।’
যা বলছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
পুলিশের এডিসির বাসায় আগুনে পুড়ে গৃহকর্মীর মৃত্যুর বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য চাওয়া হয়েছিল। কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহানা সাঈদ বলেন, ‘প্রথমত কমিশন এই ঘটনাটি অবগত নয়। কোনো মিডিয়ায় সেভাবে না আসায় হয়ত কমিশন জানতে পারেনি। তাছাড়া আমরা কোনো অভিযোগও পাইনি। পুরো বিষয়টি জানার পর আমরা বক্তব্য দিতে পারব।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১৩ বছরের একজন শিশুকে গৃহকর্মে নিয়োগ করা হয়েছে— এটি অন্যায়। এর বাইরে তিনি আইনের লোক, পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে এটি করতেই পারেন না। তিনি আইন লঙ্ঘন করেছেন।’
