জি-২০ সম্মেলন: আস্থা ফিরিয়ে একসঙ্গে চলার আহ্বান

জি-২০ সম্মেলন: আস্থা ফিরিয়ে একসঙ্গে চলার আহ্বান

আন্তর্জাতিক স্লাইড

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩ ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ

‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, সবকা প্রয়াস’ মন্ত্রে আস্থা ফিরিয়ে এনে একসঙ্গে চলার আহ্বানের মধ্য দিয়ে দিল্লিতে শুরু হয়েছে বিশ্বের শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশের জোট জি-২০-এর সম্মেলন। শনিবার ভারতের নয়াদিল্লিতে শুরু হওয়া শীর্ষ সম্মেলনের শুরুতেই আফ্রিকান ইউনিয়নকে (এইউ) নতুন সদস্য হিসাবে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। খবর জি নিউজ, এনডিটিভি, আলজাজিরা, বিবিসির।

সকাল ১০টায় জি-২০ সম্মেলনের ভেন্যু ‘ভারত মন্ডপম’-এ বিশ্বনেতাদের স্বাগত জানান নরেন্দ্র মোদি। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ভারত মন্ডপমে বিদেশি রাষ্ট্রনেতারা আসতে শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যেই ভারত মন্ডপমে বিভিন্ন দেশের নেতা এবং প্রতিনিধি দলের প্রধানরা পৌঁছে যান। এরপর ‘ট্রি অব লাইফ’ ফোয়ারার সামনে মোদির সঙ্গে সবাই ছবি তোলেন। এরপর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের প্রধানরা ভারত মন্ডপমের লেভেল-২-এ লিডারস লাউঞ্জে একত্রিত হন। শুরু হয় প্রথম অধিবেশন ‘ওয়ান আর্থ’।
হাতুড়ি ঠুকে সম্মেলনের শুভ সূচনা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আফ্রিকান ইউনিয়নকে স্থায়ী সদস্যপদ দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান আজালি আসোমানিকে আসন গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। এ সময় মোদি বলেন, ভারতে ৬০টির বেশি শহরে ২০০টির বেশি বৈঠক হয়েছে জি-২০ নিয়ে। ভারতের প্রস্তাব ছিল, আফ্রিকান ইউনিয়নকে যেন জি-২০-এর সদস্যপদ দেওয়া হয়। মোদির আহ্বানের পর আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আজালি অধিবেশনে আসন গ্রহণ করেন। আঞ্চলিক জোটগুলোর মধ্যে এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জি-২০ জোটের সদস্য ছিল।

‘ভারত মন্ডপম’-এ হিন্দিতেই বক্তব্য দেন নরেন্দ্র মোদি। এবার জি-২০ সম্মেলনে সবার নজর ছিল মধ্যমণি মোদির নেমপ্লেটে। সেখানে বড় বড় হরফে দেশের নাম লেখা ছিল ‘ভারত (BHARAT)’। উদ্বোধনী ভাষণে মোদি বলেন, ‘জি-২০ প্রেসিডেন্সি ভারতকে অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে। ভারত সব অতিথিকে স্বাগত জানাচ্ছে। সবার একসঙ্গে চলার সময় এসেছে। সবকা সাথ, সবকা বিকাশ। এক পৃথিবী, এক সংসার, এক ভবিষ্যৎ। বসুধৈব কুটুম্বকম মন্ত্রেই এবার সময় ভারতের।’

তিনি বলেন, ‘কোভিড মহামারির পরে বিশ্বে আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ সেই আস্থাহীনতারই পরিণতি। আমাদের এই আবহ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি কোভিডের মতো মহামারিকে পরাজিত করতে পারি, তবে আমরা এই আস্থার ঘাটতি সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জকেও জয় করতে পারব। আজ জি-২০-এর সভাপতি হিসাবে ভারত এই আস্থার ঘাটতিকে ভরসা ও আত্মবিশ্বাসে রূপান্তর করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে সমগ্র বিশ্বের প্রতি। আমাদের সবার একসঙ্গে চলা উচিত।’

নরেন্দ্র মোদির ভাষায়, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, সবকা প্রয়াস’ মন্ত্র অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হবে। এই মন্ত্রই আমাদের পথপ্রদর্শক হবে, আমাদের মশালবাহক হবে। উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে বিভাজন হোক, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে দূরত্ব হোক, খাদ্য ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, সন্ত্রাসবাদ, সাইবার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি বা পানীয় জল সরবরাহ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের এসব কঠিন সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের উপস্থিতিতে মোদির এই বক্তব্যকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের ধারাবাহিক চাপ সত্ত্বেও জাতিসংঘসহ কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেনি ভারত। মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগও ছিন্ন করেনি। সেই নীতিতে অটল থাকার বার্তা দিয়েই মোদি বলেছেন, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ মন্ত্রেই আমাদের আস্থাহীনতার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে।’

জি-২০ সম্মেলনের প্রথম পর্বে ছিল ‘এক পৃথিবী’ নিয়ে আলোচনা। এরপর দুপুরে মধ্যহ্নবিরতির পর বিকালে কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন ভারত ও একাধিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। অন্য রাষ্ট্রনেতারাও নিজেদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইংল্যান্ড, জাপান, জার্মানি ও ইতালির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে।

বিকাল ৩টায় শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন, ‘এক সংসার-এক পরিবার’। এই সেশনের পর শেষ হয় প্রথম দিনের মতো বৈঠক। এরপর রাষ্ট্রনেতারা নিজেদের হোটেলে চলে যান। সন্ধ্যায় ভারতমন্ডপমেই অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রনেতাদের নৈশভোজ। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর আমন্ত্রণে এই নৈশভোজের আয়োজন করা হয়ে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে রাষ্ট্রনেতা ও আমন্ত্রিতরা এই নৈশভোজে অংশ নিতে সম্মেলন স্থলে পৌঁছে যান। নৈশভোজ পর্বে ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আয়োজন ছিল বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানেরও। অতিথিদের ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীত এবং বেশকিছু বিরল বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শোনান শিল্পীরা।

প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতির এই নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্র থেকে ‘ভারত’ বিতর্কের সূত্রপাত। কারণ, আমন্ত্রণপত্রে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’-এর পরিবর্তে লেখা ছিল ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’, যা থেকেই দেশের নাম পরিবর্তন নিয়ে জল্পনার শুরু। এবার জি-২০তেও ছিল ‘ইন্ডিয়া’ বনাম ‘ভারত’। দেশের নাম পরিবর্তন নিয়ে জল্পনার মাঝেই জি-২০তে মোদির নেমপ্লেটেও উধাও হয়ে গেল ইন্ডিয়া! মোদির নামের পাশে ‘ইন্ডিয়ার’ বদলে দেশের নাম লেখা ছিল ‘ভারত’।

জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন সদস্য দেশের নেতারা। তাদের মতৈক্যের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত হয়েছে ‘নয়াদিল্লি ঘোষণা’। ভারতের সভাপতিত্বে চলমান সম্মেলনে এমন অসামান্য ঐকমত্য সবার জন্যই বড় অর্জন হিসাবে দেখা হচ্ছে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক ঘোষণায় বলেন, সুখবর রয়েছে, আমাদের টিমের কঠোর প্রচেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের সহযোগিতায় নয়াদিল্লি জি-২০ নেতাদের সম্মেলনের ঘোষণায় ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে।

তিনি বলেন, আমার অনুরোধ, এটি সব জি-২০ নেতার গ্রহণ করা উচিত। আশা করি, তেমনটিই হবে। এ সময়ে আমি সব মন্ত্রী এবং শেরপাকেও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা এটি সম্ভব করতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ পুরি জানিয়েছেন, জি-২০-এর দিল্লি ঘোষণায় ৭৩টি ফলাফল এবং ৩৯টি সংযুক্ত নথি রয়েছে, যা আগের সম্মেলনগুলোর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, জলবায়ু, জলবায়ু অর্থায়ন-সবদিকে আপনি এই জি-২০-এর আগে এবং পরে একটি সাধারণ পার্থক্য ধরতে পারবেন। একে ‘অত্যন্ত পরিপক্ব ও বুদ্ধিমান খসড়া’ হিসাবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘এটি যুদ্ধের যুগ নয়’ বলে ঘোষণা শেষ হয়েছে-এটি কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে একটি বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে। বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অনুপ্রেরণা দেবে দিল্লি ঘোষণা।

দিল্লি জি-২০ ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘জাতিসংঘের সনদের সামঞ্জস্য রেখে কোনো দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো অঞ্চল অধিগ্রহণের জন্য হুমকি দেওয়া বা বাহিনী প্রয়োগ থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে সব দেশ। পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের হুমকি দেওয়া বা পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ করার বিষয়টি একেবারে বরদাস্ত করা হবে না।’ এতে আরও বলা হয়েছে, ‘সব দেশকে আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাসহ আন্তর্জাতিক আইনের নীতি মেনে চলতে বলা হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, জি ২০ জোটের অন্তর্গত দেশগুলো বিশ্বের মোট জিডিপির ৮৫ শতাংশের অংশীদার। তাছাড়া বিশ্ব বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ এই দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণেই আছে। তাই এই জোটের দেশগুলোর নীতি সারা বিশ্বকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। তবে ভারত বরাবর বলে আসছে, জি-২০ জোটের বাইরে শতাধিক দেশের কথা কেউ বলছে না। সেই দেশগুলোর কণ্ঠস্বর হতে চাইছে ভারত। এই আবহে আফ্রিকান ইউনিয়ন আজ জি-২০-এর স্থায়ী সদস্য হওয়ায় গ্লোবাল সাউথে ভারতের প্রভাব আরও বাড়বে।

জি-২০ সম্মেলনে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ ছিল, সেটা কেটে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে একমত হয়েছে জি-২০ জোটভুক্ত সব দেশ, যা ভারতীয় কূটনীতির বড় সাফল্য হিসাবে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। ১০ মাসের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আমূল পালটে গেল জি-২০ জোটভুক্ত দেশগুলোর অবস্থান। ২০২২ সালে নভেম্বরে জি-২০ সম্মেলনের বালি ঘোষণাপত্রে ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর উল্লেখ করা হয়েছিল, আর নয়াদিল্লি ঘোষণাপত্রে ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ’ উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ ঘোষণাপত্র সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে বলে নরেন্দ্র মোদি নিজে জানিয়েছেন।

কূটনৈতিক মহলের মতে, ইউক্রেনের যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে যে এককভাবে দোষারোপ করা হয়নি, তা ভারতীয় কূটনীতির বড় জয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে একঘরে করার চেষ্টা করছে। সেটাই জি-২০-এর ক্ষেত্রে সব থেকে বড় জট ছিল। ভারতীয় কূটনীতির ম্যাজিকে সেই জটও খুলেছে। রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লি ঘোষণার মাধ্যমেই এবারের জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনের সমাপ্তি টানা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *