একেই বলে নিয়তি। শ্রীলংকার রাজাপাকসে পরিবারের দুই ভাই মাহিন্দা ও গোতাবায়ার নেতৃত্বে তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা নিয়ে ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটান। আর সেই থেকেই যৌথভাবে নায়ক বনে গিয়েছিলেন তারা। কালের পরিক্রমায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে কুক্ষিগত করেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে আটকে শিকেয় তোলেন দেশের অর্থনীতি। সেই ভঙ্গুর অর্থনীতির ভোঁতা চাকায় পিষ্ট হয়েছে দ্বীপদেশটির আপামর জনতা। দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কবলে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের। আর সেই যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেই খুলে গেছে বিক্ষুব্ধ জনতার বুজে থাকা চোখ। তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বলে দিয়েছে, দেশের এই পরিণতির জন্য দায়ী আর কেউ নন- রাজাপাকসে পরিবারের দুই ভাই মাহিন্দা আর গোতাবায়া। রাতারাতি জনরোষে পরিণত যুদ্ধজয়ী সেই ‘মানিকজোড়’ আর তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা এখন আসল ভিলেন।
নতুন এক বাঁক নিয়েছে শ্রীলংকার রাজনৈতিক ইতিহাস। এপ্রিলের শুরু থেকে বিক্ষোভকারীরা দেশকে অর্থনৈতিক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। অনেক ‘জল ঘোলা’ প্রায় নিষ্পত্তিমূলক একটি সপ্তাহ দেখতে পাচ্ছে শ্রীলংকাবাসী।
প্রথমত, মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেন যখন তার সমর্থকরা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়, দেশজুড়ে মারাত্মক সংঘর্ষ শুরু হয়। রাজাপাকসেদের মালিকানাধীন কয়েকটিসহ রাজনীতিবিদদের কয়েক ডজন বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পিঠ দেওয়ালে লেগে যাওয়া বিক্ষুব্ধ জনতা। বিপুল জনরোষ থেকে বাঁচাতে ৭৬ বছর বয়সি প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দাকে তার সরকারি বাসভবন থেকে উদ্ধার করে দেশটির সেনাবাহিনী। তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে উত্তর-পূর্বের কোণে একটি নৌঘাঁটিতে গাঢাকা দিয়ে আছেন। পরে আদালত তাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দুই-দুইবার প্রেসিডেন্ট হওয়া এমন একজন সাবেক ‘নায়কের’ জন্য এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ অপমানজনক।
মাহিন্দার এই অবমাননাকর প্রস্থান ঠেকাতে ৭২ বছর বয়সি ছোট ভাই (ভাইয়েদের ভেতর সেজ) প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া কিছুই করেননি। তিনি এখন নিজের গদি সামলাতেই ব্যস্ত। গণদাবি সত্ত্বেও পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। গণআগুনে পানি ঢালতে নরম সুরে কথা বলছেন, ছাড়ের ঘোষণাও দিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত করতে সম্মত হয়েছেন এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রস্তাবিত ক্রস-পার্টি সরকারের নেতৃত্বে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন। যদিও গোতাবায়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনেকটাই সুতোয় ঝুলছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন তিনিও সরে যেতে বাধ্য হবেন-এটি কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলংকার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী একটি পরিবারের জন্য এটি একটি নাটকীয় পতন। প্রায় তিন দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে মাহিন্দা রাজাপাকসেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা একসময় নায়ক হিসাবে চিহ্নিত করেছিল যখন ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার প্রথম মেয়াদে তামিল টাইগার বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়েছিল। যুদ্ধের পরপরই বিজয় কুচকাওয়াজ এবং গণঅনুষ্ঠানে তাকে সিংহল বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। প্রবীণ রাজনীতি-বিশ্লেষক কুশল পেরেরা বলেছেন, ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী শ্রীলংকায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় সিংহলি বৌদ্ধ নেতা। কেউ কেউ তাকে সম্রাট মাহিন্দা বলেও সম্বোধন করেছেন।’
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া তার ঘনিষ্ঠদের কাছে বলেছেন, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আগ্রহী নন, তবে দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে আনতে চান। কিন্তু দেশের মানুষের বর্তমান ক্ষোভ তাকে সে সুযোগ দেবে বলে মনে হয় না। তাই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, আরও কঠোরতার পরিচয় দিয়ে ক্ষমতায় থাকার জন্য সামরিক বাহিনীকে ‘হাতের পাঁচ’ হিসাবে রেখে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। ৮ দশক ধরে লংকায় প্রভাব বিস্তার করছে রাজাপাকসেরা। এর মধ্যে গত দুই দশক চলেছে ‘রাজাপাকসে রাজ’ পরিবারটি রাজনীতিতে আসে ১৯৩৬ সালে। মাহিন্দা রাজাপাকসের দাদা ডন ম্যাথিউ রাজাপাকসের হাত ধরে। প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিজের প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালে তিনি কঠোর হস্তে তামিল বিদ্রোহ দমন করেন। যুদ্ধের পর বিজয় কুচকাওয়াজ ও বিশাল সমাবেশে তাকে সিংহল বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কেউ কেউ তখন তাকে সম্রাট মাহিন্দা বলেও প্রশংসা করত। সেই মাহিন্দাই আজ গণধোলাইয়ের ভয়ে নৌঘাঁটিতে! তার বড় ছেলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বড় ভাই চামাল আর ছোট ভাই বাসিলও কোণঠাসা!