বাঙালিদের মধ্যে টিপ পরার রীতি চালু হলো যেভাবে

ফিচার স্পেশাল

এপ্রিল ৭, ২০২২ ১:১৩ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ বা বাঙালিদের মধ্যে অথবা দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের মধ্যে টিপ পরা নতুন কিছু নয়। কিন্তু টিপ পরার এই রীতি চালু হলো কীভাবে? এমন প্রশ্ন অনেকের।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, হাজার হাজার বছর ধরেই বিশ্বের অনেক দেশের নারীদের মধ্যে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে। এটা শুধুমাত্র বাঙালি জাতির বা হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যাপার ছিল না। আঠারো শতকে টিপের ব্যবহার খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তখনকার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার নারীরা টিপ ব্যবহার করতেন।

তিনি বলেন, সেই সময় সব ধর্মের নারীদের মধ্যেই টিপ পরার প্রচলন ছিল। তখনকার মুসলমানদের মধ্যেও টিপ ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তার মতে, ইসলামেও টিপ পরা নিষিদ্ধ করা হয়নি।

সিরাজুল ইসলাম জানান, টিপকে বরাবরই অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হয়েছে। বিশেষ করে অনুষ্ঠানে যাওয়া, বিশেষ সাজগোজ করার সময় টিপকে শেষ উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতেন নারীরা। সব ধর্ম, সব শ্রেণির নারীদের মধ্যেই এই রীতি চালু ছিল।

একসময় টিপের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষ বা নারীদের শ্রেণি বা অবস্থান বোঝাতে টিপের ব্যবহার হতো বলে এক বইতে লিখেছেন জিয়াউল হক। ‘ইতিহাসের অলিগলি’ নামের বইয়ে জিয়াউল হক টিপ প্রসঙ্গে পুরো একটি অধ্যায় লিখেছেন।

টিপকে বরাবরই অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হয়েছে।

টিপকে বরাবরই অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হয়েছে।

এতে তিনি লেখেন- কপালে টিপ বাঙালি তথা আধুনিক বাঙালি নারীর প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। স্থান কাল আর পাত্র, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ নারীরা পুরুষের তুলনায় সৌন্দর্য চর্চা করেন বেশি।…বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে কপালে বড় একটি টিপ দেয়া, তার সৌন্দর্য চর্চার অন্যতম এক অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে এটা প্রায় প্রতিটি নারীর জন্যই একরকম বাধ্যতামূলক বিষয় যেন।

তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সমাজে এ প্রথাটা এলো কোথা হতে? এর উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়, বাল্মীকি যুগে।’

এর বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এই রীতি চালু হয়েছে প্রায় ৯৫০০ থেকে ১১৫০০ বছর আগে থেকে, যাকে বাল্মীকি যুগ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। সেই সময় তৎকালীন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ বা শ্রেণিভেদ প্রবল ছিল। তখন বলা হতো- ব্রাহ্মণরা উচ্চ শ্রেণির, তারা ঈশ্বরের অতি নিকটজন, পূত-পবিত্র। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে তারা কপালে সাদা তিলক (চন্দন তিলক) দিতেন। এখনো দেন। আর ক্ষৈত্রিয় হলো যোদ্ধা শ্রেণি, তাদেরকে বীর হিসেবে গণ্য করা হতো। ক্ষিপ্ততা, হিংস্রতা ও সাহসের প্রতীক হিসেবে তারা কপালে লাল টিপ দিতো।’

‘এছাড়া বৈশ্যয় শ্রেণির লোকজন হলো ব্যবসায়ী, পেশাই হলো ব্যবসা। এরা কপালে হলুদ রঙের টিপ ব্যবহার করতো। আর সমাজে সবচেয়ে নিচু লোকজন হলো শূদ্ররা। ….তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল কালো রঙের টিপ। তারা কপালে কালো টিপ ব্যবহার করতে বাধ্য হতো। তখন নারীদের মধ্যেও ভিন্ন মাত্রার শ্রেণিভেদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। শ্রেণিভেদ অনুসারে তাদের বেলাতেও এই টিপ ব্যবহারে একটু ভিন্নতা ছিল।’

তিনি আরো লিখেছেন, সেই সময় যেসব নারীদের মন্দিরে উৎসর্গ করা হতো, তাদের চিহ্নিত করার জন্যও টিপ দেওয়ার রীতি চালু হয়েছিল। আবার উচ্চ বর্ণের বিবাহিত নারীরাও বিয়ের চিহ্নস্বরূপ কপালে সিঁদুরের টিপ পরতেন।

অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ টিপ।

অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ টিপ।

তবে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ‘আঠারো বা উনিশ শতকের আগে অনেক সময় টিপ নারীদের শ্রেণি, মর্যাদা ইত্যাদির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এরপর থেকে টিপ সবার কাছে সাধারণ সৌন্দর্য চর্চার একটি উপাদানে পরিণত হয়েছে।’

বাঙালি সংস্কৃতিতে টিপের ব্যবহার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৌমিত্র শেখর দে বলেন, ‘টিপকে এখন মানুষ সৌন্দর্য হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু এই টিপের একটা প্রতীকী ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে, ব্যক্তির ‘থার্ড আই’ হিসেবে এটাকে চিহ্নিত করা হয়। এটা হচ্ছে দূরদৃষ্টি প্রকাশক। এটা সিম্বোলিক হয়ে ধীরে ধীরে টিপ-এ পরিণত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তৃতীয় চক্ষুর এই ব্যাপারটিকে সমাজ ধীরে ধীরে সৌন্দর্য হিসেবে সমাজ গ্রহণ করেছে এবং আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। সেটা হয়েছে বহু আগে থেকে। বলা যায়, প্রাচীন, মধ্যযুগ অতিক্রম করে এটা সাম্প্রতিক কালে এসে পৌঁছেছে।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *