আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন সেক্টরে ‘ভয়াবহ’ দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির নেতারা এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রকাশ্যে তুলে ধরতে চান। এজন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করা বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ক্ষমতাসীন দলের সাবেক ও বর্তমান এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে দলটি। প্রশাসনিক বিষয়ে অভিজ্ঞদের দিয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবেন। পরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে বিএনপি। একই সঙ্গে তথ্য-প্রমাণসহ সরকার সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের নামে লিফলেট তৈরি ও বিতরণ করা হবে। সোমবার রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, সাবেক সেনাবাহিনীর প্রধান আজিজ আহমেদ ও সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের মতো সরকারে আরও অনেক রয়েছে। তাদের নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম জনগণের সামনে আমরা তুলে ধরব। দুর্নীতিবাজদের তালিকা আমরা প্রকাশ করব। এ নিয়ে দায়িত্বশীলরা কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি আর লুটপাটে দেশের অর্থনীতি তছনছ হয়ে গেছে। এ কারণে রিজার্ভ ও ডলারের ঘাটতি দেখা গেছে। এখন আজিজ-বেনজীরের পাহাড়সম দুর্নীতির তথ্য বের হলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো তৎপরতা নেই কেন?
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপির নেতৃত্বে দেশের নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ৬৩টি রাজনৈতিক দল বর্জন করে। নেতাদের ভাষ্য, ১০ শতাংশের বেশি মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রে যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা নেমে আসে। এই অবস্থায় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা সারা দেশ সফর শুরু করেন। এ অবস্থার মাঝে সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে সপরিবারে স্যাংশন দেয়। একই সঙ্গে দেশের গণমাধ্যমে পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ পরিবেশন করে যাচ্ছে। সোমবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গণমাধ্যমে আজিজ আহমেদ ও বেনজীর আহমেদের বিষয়ে যেভাবে খবর নিয়ে সরব সেখানে সরকার কেন নীরব, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কয়েকজন নেতা। বৈঠকে তারা বলেন, এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশে সরকারের দিক থেকে কোনো বাধাও দেওয়া হচ্ছে না। অথচ সংবাদ প্রকাশের বিষয়ে সরকার অতটা সহনশীলও নয়। নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, আজিজ ও বেনজীর ইস্যুকে সামনে রেখে সরকার অন্য কোনো বড় ধরনের কাজ করছে কিনা? সরকার অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে বড় চাপে আছে যা প্রকাশ করতে চাইছে না; এ কারণে আজিজ-বেনজীর ইস্যু জিইয়ে রাখছে। নেতাদের ধারণা, এ কারণে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ধারাবাহিকভাবে বেনজীর ও আজিজ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, দুজন সাবেক কর্মকর্তাসহ সরকারসংশ্লিষ্ট আরও অনেকের দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণসহ লিফলেট বিতরণ করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং সংসদ সদস্য নিহত আনোয়ারুল আজিমের বিরুদ্ধে নানা ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন হয়েছে। বিএনপির অনুসন্ধানে আরও অসংখ্য ‘আজিজ, বেনজীর ও আজিমে’র তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটনের পর তা নতুন মাত্রা পাবে। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে অপরাধের মাত্রা দেশের মানুষ বুঝতে পারবে বলে তাদের বিশ্বাস। অনুসন্ধান কমিটি গঠনে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত নিবিড়ভাবে অনুসন্ধানে ‘সত্য প্রমাণিত’ তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হবে। সময়মতো দেশবাসী ও বিদেশিদের সামনে তা প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় আরও কতজন আজিজ, বেনজীর ও আজিমের জন্ম হয়েছে, তা তারা খুঁজে বের করবে।
সূত্রমতে, বৈঠকে সাবেক সেনাবাহিনীর প্রধান আজিজ আহমেদ ও পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির ঘটনায় সরকারের মনোভাব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বিএনপি নেতাদের আলোচনায় সরকারসংশ্লিষ্ট আরও অনেকের দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি উঠে আসে। কলকাতায় খুন হওয়া সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন তারা। বৈঠকে নেতাদের আলোচনায় আনারের একজন রাজনৈতিক গডফাদার নিয়েও আলোচনা হয়। তবে ভারতের মাটিতে একজন এমপিকে খুন ও লাশ গুম করা হলেও সরকারের আচরণ রহস্যজনক মনে করছেন নেতারা। বৈঠকে নেতারা বলেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের এ ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ বিএনপি আগে থেকেই করে আসছিল। তাদের সেই অভিযোগের সত্যতা এখন গণমাধ্যমের মাধ্যমে বের হয়ে আসছে।
বিএনপি নেতাদের মতে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলন পুরোপুরি ব্যর্থ বলা যাবে না। গণতন্ত্র, মানবাধিকার হরণসহ সরকারের নানা অপকর্ম তুলে ধরে বিএনপি ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছিল। সরকারের নানা অত্যাচার ও নির্যাতনের পরও বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোট বর্জন করেছে জনগণ। তারা ভোটকেন্দ্রে যায়নি, ভোটের হার বাড়িয়ে প্রচার করা হয়েছে। ভোট বর্জনে জনগণের সেই অকুণ্ঠ সমর্থনে আশান্বিত হয়েছেন তারা। এখন সরকারের আশীর্বাদে নানা অপরাধ ও দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত ব্যাপক প্রচার করে সুফল পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তারা।
বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে ফের আলোচনা : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোমবারের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করার বিষয়ে আবারও আলোচনা উঠেছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ অনির্ধারিত এই আলোচনা উত্থাপন করলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। কাউন্সিলের পক্ষে তিনিও যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন, এখনই কাউন্সিল করার সময়। দলের চেয়ারম্যানও নেতাদের বক্তব্যকে সায় দেন। তবে এ নিয়ে আলোচনায় বাড়াননি।