কান পাকা রোগ আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি দেখা দেয়। কান পাকার পাশাপাশি অনেকে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে। সঠিক চিকিৎসা নিয়ে এই রোগ পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।
কান পাকা রোগ ও এর সমাধান নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. জাহির আল-আমিন।
কানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। বহিঃকর্ণ যেটি আমরা সাধারণত দেখতে পাই, মধ্যকর্ণ যেটি কানের পর্দার ওপাশে থাকে এবং অন্তঃকর্ণ যেটি থেকে কানের স্নায়ু তৈরি হয়। কানের পর্দা কানের ফুটার শেষ প্রান্তে অবস্থিত। এ পর্দার কাজ হল আমরা যে শব্দ শুনি সে শব্দটিকে মধ্য কান দিয়ে কানের স্নায়ুতে নিয়ে যাওয়া।
কানের কাজ প্রধানত দুটি। একটি হল শব্দ শোনা যার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কানের যে দ্বিতীয় কাজটি আছে সেটি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জানি না- সেটি হল শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা। মস্তিষ্কের বাইরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করার যে অঙ্গ আছে তার মধ্যে অন্তঃকর্ণ প্রধান ও অন্যতম। কান পাকা রোগ সাধারণত ছোটোবেলাতে শুরু হয়ে থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের কানের ইনফেকশন বা সর্দি-কাশি যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় কমন কোল্ড বলে থাকি তা থেকে হয়ে থাকে। এমন কোনো বাচ্চা নেই যার জীবনে কোনো না কোনো সময় একবারও কানের ইনফেকশন হয়নি। বেশিরভাগ সময় সুষ্ঠু চিকিৎসার মাধ্যমে এ ইনফেকশনের সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। যদি এ ইনফেকশনের সুষ্ঠু চিকিৎসা না হয় বা পর্যাপ্ত চিকিৎসা না হয় তাহলে ইনফেকশন থেকে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে।
যেসব বাচ্চা এডেনয়েড গ্রন্থির প্রদাহে অনেকদিন ধরে ভোগে বা যেসব বাচ্চার এডেনয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে যায় তাদের কানের সমস্যা আরও বেশি হয়ে থাকে। ঘনঘন কানের ইনফেকশন থেকে কানের পর্দা ফেটে যায়। অনেক সময় টনসিল, নাক বা সাইনাসের ইনফেকশন ঘনঘন হতে থাকলে বা সবসময় নাক বন্ধ থাকলেও কানের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
এডেনয়েড, টনসিল বা নাকের সমস্যা অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে এটি ইউস্টেশিয়ান টিউবের ওপর প্রভাব ফেলে এবং দেখা যায় টনসিল। এডেনয়েড বা নাকের সমস্যার চিকিৎসা হওয়ার পরও ইউস্টেশিয়ান টিউবের ফাংশন কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণ ফিরে আসে না। এর ফলে কান পাকা বা কানের পর্দা ফাটা রোগীর চিকিৎসা জটিল আকার ধারণ করে বা এটি সহজে সারতে চায় না।
বড়দের ক্ষেত্রে কান পাকা রোগটি সাধারণত ছোটোবেলা থেকেই শুরু হয়ে থাকে। তাদের হয় ছোটোবেলা থেকেই কানের পর্দা ফাটা থাকে অথবা ইউস্টেশিয়ান টিউবের কার্যক্ষমতা ব্যবহৃত হওয়ার জন্য কানের পর্দা আগে থেকেই দুর্বল থাকে। অনেক সময় দেখি কানের ভেতর পানি গেলে কান পাকা শুরু হয়। আপাতত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়; কিন্তু কানের ভেতরে পানি গেলে কান পাকা রোগ শুরু হওয়ার কথা নয়।
যদি তাই হতো তাহলে যারা নিয়মিত সাঁতার কাটেন তাদের কান সব সময় পাকা থাকত। প্রকৃত তথ্য হল, এ রোগীদের কানের পর্দা আগে থেকেই ফাটা থাকে যার ফলে কানের ভেতর পানি গেলে তাদের কান পেকে যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায় অল্প আঘাতেই কানের পর্দা ফেটে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কানের পর্দা সুস্থ থাকলে অল্প আঘাতে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার কথা না- যদি এ রকম ঘটে তাহলে বুঝতে হবে, কানের পর্দা আগে থেকেই অসুস্থ বা দুর্বল ছিল।
অবশ্য কানের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হলে সুস্থ পর্দাও ফেটে যেতে পারে। যেমনটি হতে পারে কানে ভালোমতো থাপ্পড় লাগলে। অল্প সর্দি-কাশিতে কানের পর্দা ফেটে গিয়ে পুঁজ-পানি বের হচ্ছে। কানের পর্দা সুস্থ থাকলে এ রকম হওয়ার কথা নয়। বয়স্ক রোগীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছোটোবেলা থেকে কানের পর্দা দুর্বল থাকে অথবা ক্রমাগত নাক বা সাইনাসের প্রদাহের কারণে বা ক্ষেত্রবিশেষে টনসিলের ক্রমাগত প্রদাহের কারণে কানের পর্দা দুর্বল হয়ে যায়।
উপসর্গ বা সমস্যা
রোগী কানে কম শুনতে পারেন- এটা সামান্য থেকে মারাত্মক পর্যন্ত হতে পারে। কান পাকার জন্য কান দিয়ে পুঁজ-পানি বের হয়। অনেক সময় মাথা ঘুরায়। মাথার ভেতরে ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়। অনেক সময় কানে ব্যথা হতে পারে। এ কান দিয়ে পুঁজ-পানি পড়াটা প্রাথমিক পর্যায়ে মাঝে মাঝে হয়; কিন্তু ক্রমাগত কান পাকতে থাকলে অনেক সময় দেখা যায়, কান কোনো সময় শুকাতেই চায় না। অনেক সময় আবার সর্দি-কাশি লাগলেই কান দিয়ে পানি বের হতে থাকে।
প্রকারভেদ
সাধারণত কানের পর্দা ফাটা দুই রকমের হয়ে থাকে- একটিতে পর্দার সামনের অংশ ফুটা থাকে অন্যটিতে কানের পর্দার পেছনের অংশটিতে ফুটা থাকে। পেছনের ফুটা সাধারণত মারাত্মক- চিকিৎসা অতি শিগগিরই শুরু করা দরকার। অনেক সময় অনেক দিন ধরে কানের পর্দা ফুটা থাকার ফলে এবং ঘনঘন কানের ইনফেকশন থাকার ফলে পর্দাটা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
করণীয়
পর্দা ফাটা থাকলে অবশ্যই কান শুকনা রাখতে হবে। কানের ভেতর যেন পানি না যায়। গোসল করার সময় তুলাতে তেল দিয়ে ভিজিয়ে তারপর তুলা চিপে কানে দিয়ে গোসল করতে হবে। কোনো সময়ই পানির তলে সাঁতার কাটা যাবে না বা পানিতে ঝাঁপ দেয়া যাবে না। কানে ইনফেকশন থাকলে কানটি ঠিকমতো পরিষ্কার করা দরকার এবং তারপর কানে অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ দিতে হয়।
কান পরিষ্কার করা জরুরি এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে এটি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কদাচিৎ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হবে বা ইনজেকশন দেয়া লাগতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ কান শুকনা অবস্থায় কানে দেয়া নিষেধ- এটি কানে মারাত্মক ক্ষতি করে ফেলতে পারে, এমনকি কানে শোনা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কাজেই শুকনা কানে ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ ব্যবহার করার প্রবণতা অবশ্যই দূর করতে হবে।
কানে শোনা এবং কানের অন্যান্য ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য অডিওগ্রাম করানো দরকার। এতে বোঝা যায় কান কতখানি নষ্ট হয়েছে। অনেক সময় সমস্যা আমরা বুঝতে পারি না; কিন্তু ভেতরে ভেতরে কানের ক্ষতি হতে থাকে এবং শ্রবণশক্তি ক্রমাগত কমতে থাকে। কাজেই প্রতি ৩ থেকে ৬ মাস অন্তর কানের হেয়ারিং টেস্ট করে শ্রবণশক্তির পরিমাণ রেকর্ড করা উচিত।