এটিএম সেবা: প্রতিদিন অরক্ষিত ট্রান্সফার ৪০০ কোটি টাকা

এটিএম সেবা: প্রতিদিন অরক্ষিত ট্রান্সফার ৪০০ কোটি টাকা

অর্থনীতি স্লাইড

মার্চ ১৪, ২০২৩ ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ

এটিএম নেটওয়ার্কের আওতায় ঝুঁকি মাথায় নিয়েই প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা সারা দেশের বুথগুলোতে স্থানান্তর হচ্ছে। অরক্ষিত অবস্থায় এই অর্থ স্থানান্তর চলছে বছরের পর বছর।

মানি ট্রান্সফার বা অর্থ এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রয়োজনীয় গানম্যান ছাড়াই তারা টাকা স্থানান্তর করছে। এমনকি কোটি কোটি টাকা স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানগুলো পুলিশকেও অবগত করেনি। সার্ভিস চার্জ কম পাওয়ার শঙ্কার তারা নিজেরাই ঝুঁকি নিয়ে এ কাজটি করছে। এর ফলে নেমে আসছে বিপর্যয়।

যার সর্বশেষ ঘটনা রাজধানীর তুরাগে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাই হয়ে যাওয়া। এর আগেও একাধিকবার এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে অর্থের পরিমাণ কম হওয়ায় সবাই বিষয়টি চেপে যান। কিন্তু এবারের ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন ১৮ লাখ লেনদেন করে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো। তাদের জবাবদিহিতার কোনো জায়গাও নেই। কারও টাকা খোয়া গেলে মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানগুলো যে ক্ষতিপূরণ দেয় তা আবার পুষিয়ে নেয় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে। ফলে তাদের হারানোর কিছু থাকে না। কিন্তু ঝুঁকি তৈরি করে আর্থিক লেনদেন বা মানি ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে।

সূত্রমতে, ৬২টি ব্যাংক চারটি আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এভাবে এটিএম বুথে টাকা পাঠায়। এগুলো হলো-মানিপ্ল্যান্ট, অর্নেড, গার্ড দ্য সিল্ড এবং সিকোরেন্স। ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে বড় এটিএম নেটওয়ার্ক ড্চা-বাংলা ব্যাংকের। এ ব্যাংকের মাধ্যমেই প্রতিদিন একটি আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান গড়ে প্রায় আট লাখ টাকা লেনদেন করে। যার পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এভাবে চারটি প্রতিষ্ঠান গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করে। কিন্তু সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় এই প্রক্রিয়াটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।

তথ্য বলছে, বড় অঙ্কের টাকা বহনের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-কানুনই মানছে না মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান দুষছে ব্যাংককে। আর ব্যাংক দুষছে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানকে। সংশ্লিষ্ট আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান বলছে তারা সার্ভিস চার্জ খুবই কম পাচ্ছেন। তাই সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সব শর্ত মানতে পারছেন না।

অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বলছে, আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে। চুক্তির ভিত্তিতেই তারা সেবা দিচ্ছে। কারও না পোষালে সেবাদানে বিরত থাকতে পারেন। এ কাজে কাউকে বাধ্য করা হচ্ছে না। সম্প্রতি রাজধানীর তুরাগে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ডাকাতির ঘটনার বিষয়টি সামনে আসে। ওই টাকা বহন করছিল মানি প্লান্ট লিমিটেড।

সূত্র মতে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম সেবার শুরু থেকেই (২০০৯ সাল) মানি প্লান্ট টাকা লোড-আনলোডের কাজে জড়িত। পরে আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান এই কাজে যোগ দেয়। কিন্তু সার্ভিস চার্জ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সঙ্গে এটিএম সেবাসংক্রান্ত আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের বিরোধ দেখা দেয়। সম্প্রতি এ বিরোধ আরও বেড়েছে। আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, শুরুতে যে সার্ভিস চার্জ ছিল, বর্তমানে তা কমে গেছে। তাই তাদের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই সেবা।

জানতে চাইলে টেকনো মিডিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং মানি প্লান্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ বলেন, সার্ভিস চার্জ কমিয়ে দেওয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে আমরা নানা অসুবিধার মধ্যে পড়েছি। সার্ভিস চার্জ একেবারেই নগণ্য। প্রতিমাসে এটিএম প্রতি ৬-৭ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ দেওয়া হয়। একটি গাড়িতে দৈনিক সর্বোচ্চ ২০টি এটিএম বুথে টাকা লোড করা যায়। সার্ভিস চার্জ একেবারে কম হওয়ায় সার্ভিস দেওয়ার শর্তগুলো পরিপূর্ণভাবে পূরণ করতে পারি না।

তিনি বলেন, একজন ব্যবসায়ী যখন ব্যবসা করেন তখন তিনি রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্টের কথা চিন্তা করেন। আমার অনেক গাড়ি এবং কর্মী ব্যবহার করি। কিন্তু তাদের গুরুত্ব সহকারে দেখতে পারি না। মাসের শেষে যখন বিল সাবমিট করি তখন ব্যাংক থেকে ঠিকমতো বিল পাই না। বিল আদায়ের বিষয়টি অনেক পেইনফুল। মাঝেমধ্যেই জরিমানা করা হয়। যানজটের কারণে অনেক সময়ই বুথে টাকা নিয়ে যেতে দেরি হয়। তাই ঠিকমতো সার্র্ভিস দিতে পারি না। তখন জরিমানা দিতে হয়।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে এক হাজার লোক কাজ করেন। এদের মধ্যে যদি কেউ ডাকাত চক্রের সদস্যদের কাছে তথ্য পাচার করে থাকেন তাহলে তাকেও আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। ডিবি পুলিশ ঘটনার দিন প্রাথমিকভাবে আমাদের দুজন কর্মীকে আটকের কথা বললেও প্রকৃত অর্থে কাউকে আটক করেনি। শুধু তাদের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে।

তিনি বলেন, গাজীপুর এবং সাভার এলাকা টাকা পরিবহণের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ স্থান। ২০১২-১৩ সালের দিকে একবার গাজীপুরে প্রায় দুই কোটি টাকা ছিনতাই হয়। ওই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের কারও সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৩ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত এ ধরনের আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি চাই, যে চক্র ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের নির্মূল করা হোক। জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত হোক।

অপর এক আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, পর্যাপ্ত সার্ভিস চার্জ কম পাওয়ার কারণে ইন্স্যরেন্সসহ অন্যান্য বিষয়গুলো ঠিকমতো মেনটেইন করতে পারি না। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পুরোপুরি মেনটেইন করতে হলে যে সার্ভিস চার্জ পাই তার পুরোটাই দিয়ে দিতে হয়। তাই ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার জন্য ফাঁক-ফোকর খোঁজেন। সাধারণভাবে একটি গাড়িত পাঁচজন লোক ও একজন গানম্যান থাকার কথা। গাড়ি মেনটেইন কস্ট ও তেল খরচ লাগে। সম্প্রতি ডলারের রেট বেড়ে গেছে। তেলের দাম বেড়ে গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু সার্ভিস চার্জ বাড়ছে না।

টাকা বহনের সময় কেন পর্যাপ্ত গানম্যান সঙ্গে রাখা হয় না-জানতে চাইলে টেকনো মিডিয়া লিমিটেডের পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে যে, বেসরকারি পর্যায়ে কোনো গানম্যান ব্যবহার করা যাবে না। আমরা তদবির করার পর প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করা হয়।

তিনি বলেন, আমরা যারা প্রতিনিয়ত মোটা অঙ্কের অর্থ পরিবহণ করি তাদের নিজস্ব গানম্যানের লাইসেন্স থাকা উচিত। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের কোনো গানম্যানের লাইসেন্স দেওয়া হয় না। যেসব গানম্যান নিয়োগ করি তাদের অনেকেই অবসরপ্রাপ্ত সেনা হাবিলদার। যেসব হাবিলদারের ব্যক্তিগত গান লাইসেন্স আছে তাদের নিয়োগের জন্য খুঁজে পাওয়াও কঠিন। এ কারণে টাকা বহনকালে সব সময় গানম্যান দেওয়া যায় না।

চানতে চাইলে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ডিএমডি শাহ আলম পাটোয়ারী বলেন, পুরো বিষয়টিই কমার্শিয়াল। যারা আমাদের এটিএম সেবা দেন তাদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে। চুক্তি অনুযায়ীই তারা কাজ করেন। লাভ-লস তাদের বিষয়। কারও লস হলে তিনি সেবা দিতে বাধ্য নন। তবে সেবা দিতে গিয়ে গাফিলতি করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গ্রাহকদের স্বার্থেই আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে থাকি।

এক প্রশ্নের জবাবে ব্যাংক কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, সার্ভিস চার্জ বাড়ানোর বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সময়ে সময়ে আমরা বিষয়টি রিভিউ করে থাকি।

এদিকে ৯ মার্চ তুরাগ এলাকা থেকে ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনার তদন্তে শিগগিরই আরও বড় অগ্রগতি হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আটজনকে রোববার আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাদের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সোমবার রিমান্ডের প্রথম দিন শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে তারা ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। ঘটনায় জড়িত হিসাবে আরও কয়েকজনের নাম জানিয়েছে। তাদের গ্রেফতারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে এরই মধ্যে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

৯ মার্চের ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরপুর ডিওএইচএস অফিস থেকে সকাল ৭টার দিকে মানি প্লান্টের তিনটি গাড়ি বের হয়। সব গাড়ির গন্তব্য ছিল সাভার-আশুলিয়া। ডাকাতির কবলে পড়া গাড়িটি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তুরাগের দিয়াবাড়ীর ঘটনাস্থলে যায়। তিনটি গাড়ির মধ্যে ওই গাড়িটি ছিল সবার আগে। একসঙ্গে তিনটি গাড়ি থাকলেও একটি গাড়িতে একজন গানম্যান ছিলেন। অন্য দুটিতে কোনো গানম্যান ছিলেন না বলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কালো রংয়ের একটি গাড়ি মানি প্লান্টের গাড়িকে ফলো করছিল। ডাকাতদের গাড়িটি একবার ওই গাড়ির সামনে যায়, আরেকবার পেছনে যায়। গাড়িটি তুরাগের একটি ব্রিজ পার হয়ে ফাঁকা জায়গায় গেলে পেছনে ধাক্কা দিয়ে সামনে গিয়ে আটকে দেয়। ডাকাতদের মধ্যে একজন ছিল সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। সে নিজেকে ডিবি পুলিশ বলে পরিচয় দেয়। আচমকা গাড়ির দরজা ভেঙে ফেলে। গাড়িতে থাকা লোকদের মারধর শুরু করে। পরে তাদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে আমাদের গাড়ি নিয়ে চম্পট দেয় ডাকাতরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *