ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের ১৩ তলা ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টারে ১৯টি রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড। এমনকি প্রতি ফ্লোরে রয়েছে একাধিক রেস্টুরেন্ট। অথচ ভবনে নেই জরুরি নির্গমন পথ। এমনকি প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ছিটেফোঁটাও নেই ভবনজুড়ে। শুধু আমিন আহমেদ সেন্টার নয়, রাজধানীর অলিগলিতেও চোখে পড়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ‘রেস্টুরেন্ট ভবন’।
ধানমন্ডি : সাত মসজিদ রোডের গাউসিয়া টুইন পেক নামের ভবনে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ২০টি। ভবনটির নিরাপত্তা হুমকির মুখে। ভবনের ছবি ইতোমধ্যে ইন্টারনেটে ভাইরাল। ফলে নড়েচড়ে বসেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রোববার দুপুরে ভবন পরিদর্শনে যান রাজউকের সংশ্লিষ্ট জোনের কর্মকর্তারা। এ সময় তারা ভবনের মূল নকশাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। দুপুর ১টা থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজউকের পরিদর্শন কার্যক্রম চলে।
ভবনে গিয়ে দেখা যায়, রাজউকের জোন-৫ এর পরিচালক হামিদুল ইসলামের নেতৃত্বে সংস্থাটির একটি টিম কাগজপত্র পরীক্ষা করছে। মূলত ভবনের নকশা ও ভবন ব্যবহারের ছাড়পত্র দেখতে চাচ্ছেন তারা। এ সময় রাজউক পরিচালক হামিদুল ইসলাম বলেন, এ ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট থাকার কথা নয়। কারণ তারা রেস্টুরেন্ট হিসাবে ভবন ব্যবহারের অনুমোদন নেননি। তবে আমরা এর নকশাসহ অন্যান্য কাগজপত্র পরীক্ষা করছি। এটি ছাড়াও আশপাশের যেসব ভবনে রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে পর্যায়ক্রমে সেগুলো পরিদর্শন করা হবে।
রাজউক জানায়, সাতমসজিদ রোডের যেসব ভবন আবাসিক অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর মধ্যে গাউছিয়া টুইন পেক ভবনে সোমবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজউক।
তবে ভবন কর্তৃপক্ষ রাজউকের এমন পরিদর্শন কার্যক্রমে বিরক্ত। তাদের দাবি, সবকিছু ঠিক থাকার পরও অহেতুক মিডিয়া ট্রায়ালের কারণে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এতে ভবনটি ঘিরে অন্তত ২ হাজার লোকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে গাউসিয়া অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহসান আনোয়ার বলেন, নিরাপত্তা নেই বলে ঢালাওভাবে ভবনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অথচ বাস্তবে বিষয়টি ঠিক উলটো। কারণ ভবনের কোথাও গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে না। নিচে উন্মুক্ত জায়গায় সিলিন্ডার রেখে পাইপের মাধ্যমে রেস্টুরেন্টগুলোতে সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
একই অভিযোগ পার্শ্ববর্তী কেবি স্কয়ার ভবনের মালিকপক্ষের। ভবন মালিক সাহিনূর ভূঁইয়া বলেন, বেইলি রোডের ঘটনা নিঃসন্দেহে সবার জন্য শিক্ষণীয়। তবে তার ভবনে নিরাপত্তার সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে ভবনের পেছনে খোলা জায়গায়। তবে সরকারি সংস্থাগুলো যদি নিয়মিত নজরদারি অব্যাহত রাখে তাহলে সবার জন্যই মঙ্গলজনক হয়।
ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে ওভারব্রিজের পাশেই ১৩ তলা কেবি স্কয়ার। এর প্রতি ফ্লোরে ব্যবসা খুলেছে একাধিক রেস্টুরেন্ট। রাস্তা থেকেই নিয়ন সাইনে ১৭টি রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড দেখা যায়। সাতমসজিদ রোডে ১২ তলা রূপায়ণ জেড আর প্লাজায় রয়েছে ১২টি রেস্টুরেন্ট। এমনকি বেজমেন্টও বাদ পড়েনি। সংকীর্ণ ভূগর্ভস্থ পার্কিংয়ে তৈরি হয়েছে ধানমন্ডি কাবাব নামের বাংলা খাবার হোটেল।
রোববার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সাতমসজিদ রোডের পুরাতন ইউআইইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনটিতে সম্প্রতি চেইন সুপার শপ ইউনিমার্ট ব্যবসা খুলেছে। ৬ তলা ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ইউনিমার্টের বিভিন্ন পণ্য থরে থরে সাজানো। উপরের তিনটি ফ্লোরে ফুডকোর্ট। রাজধানীর নামিদামি বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের শাখা আছে এখানে। অথচ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা অপ্রতুল। বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে রান্নাঘরেই আছে বড় আকারের গ্যাস সিলিন্ডার। এছাড়া ভবনের কোথাও নেই আগুন নেভানোর প্রাথমিক সামগ্রী। ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে শংকর পর্যন্ত এগোলে দুপাশে সারি সাড়ি বহুতল ভবনের প্রায় প্রতিটিতেই এমন একাধিক হোটেল রেস্টুরেন্ট দেখা যায়।
গুলশান-বনানী : গুলশান-২ নম্বর সার্কেলে একটি আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে চলছে জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট সুলতান ডাইন। তাদের কাচ্চি বিরিয়ানির সুনাম অনেকের মুখে মুখে। ফলে দিনভর রেস্টুরেন্টে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। রোববার সরেজমিন দেখা যায়, দুপুর দেড়টায় রেস্টুরেন্টের প্রায় সব টেবিল ভর্তি। পার্সেল নিতে কাউন্টারের সামনে অপেক্ষমাণ অনেকে। এক টেবিলে কথা হয় মনিরুজ্জামান নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু অহরহ সবার চোখের সামনেই এসব হচ্ছে। যথাসময়ে রাজউক বা ফায়ার সার্ভিস প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না। শুধু দুর্ঘটনা ঘটলেই কিছুদিন হইচই হয়। এরপর ফের সবকিছু স্বাভাবিক। রেস্টুরেন্টের অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যানেজার মোহাম্মদ কচি বলেন, তাদের কাছে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) রয়েছে। তবে এগুলো ব্যবহার করার মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল নেই।
বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ’র ২২ তলা এফআর টাওয়ারে সেই ভয়াবহ আগুনের ক্ষত এখনো শুকায়নি। অথচ তার পাশের ১৮ তলা হকার্স প্লাজায় এখনো পর্যন্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভবনের নিচতলায় খুলেছে টিউলিপ নামের রেস্টুরেন্ট। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে। অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেস্টুরেন্টকর্মী বলেন, তাদের রান্নাঘর ছোট। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কম।
মিরপুর : সনি সিনেমা হলের আশপাশে অর্ধশতাধিক রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে। এর কোনটি অনুমোদিত আর কোনটির অনুমোদন নেই তা বোঝা মুশকিল। তবে বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ছিটেফোঁটাও নেই। মিরপুর ১ নম্বর ঈদগাহ মাঠের পাশের ৬ তলা ভবনজুড়ে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট। টাইটাইনিক রুফ, বার্গারলজি, ফুকো, প্যারাডাইজ কিচেন, রোড সাইড কিচেনসহ আরও অনেক বাহারি নাম। এসব রেস্টুরেন্টের প্রতিটিতেই ব্যবহার হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। অথচ লিফট না থাকায় সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন ক্রেতারা। এছাড়া ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ছিটেফোঁটাও নেই।
মিরপুর ১১ নম্বরের ৩ নম্বর রোডে আরএসএইচ টাওয়ারে ১০ তলার ছাদে তৈরি হয়েছে ৩৬০ নামের রেস্টুরেন্ট। ভবনের নিচের ফ্লোরগুলোতে ব্যাংক ও বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৮টি অফিস রয়েছে। অথচ এ ভবনেরও কোনো জরুরি বহির্গমন ব্যবস্থা নেই। এমনকি অপ্রশস্ত সিঁড়িতে একসঙ্গে দুজন পাশাপাশি চলতে পারে না।
মিরপুর ৭ নম্বরের ৩ নম্বর তিতাস ভবন নামে পরিচিত একটি বহুতল ভবনের ৯ ও ১০ তলায় মেট্রো ইসকেপ ও মেট্রো কিউসাইন নামে দুটি রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে। যথারীতি তাদের রান্নাঘরেই আছে একাধিক বিশাল আকৃতির গ্যাস সিলিন্ডার। অথচ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার সাব্বিরের দাবি, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই।
যাত্রাবাড়ী : শনির আখড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বর্ণমালা স্কুল রোড, জিয়া সরণি সড়ক ও গোয়ালবাড়ী মোড়ের প্রায় প্রতিটি ভবনেই নামিদামি রেস্টুরেন্ট। এর মধ্যে স্কাই ভিউ পার্টি সেন্টার, ভূতের আড্ডা থাই চাইনিজ, সয়াসদি চাইনিজ, দক্ষিণা কিচেন ও শর্মা কিংসহ হরেক নামের সাইনবোর্ড।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব রেস্টুরেন্ট ভবনের বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া প্রতিটি রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরেই চুলার পাশে সিলিন্ডার রাখা হয়। ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি শতভাগ। আবার এর বিপরীতে ফায়ার সেফটির ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেই। বেশ কয়েকটি ভবন মোটা কাচের ফ্রেমে আটকানো। ফলে স্বাভাবিক বাতাস চলাচলের ব্যবস্থাও নেই। স্থানীয় দনিয়া কলেজের শিক্ষার্থী রাফিন বলেন, এলাকার বহুতল অনেক ভবনজুড়ে রেস্টুরেন্টের বহর। প্রায় সব রেস্টুরেন্টে গ্যাস সিলিন্ডার রান্নাঘরেই রাখা হয়। এতে দুর্ঘটনার বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, ব্যাঙের ছাতার মতো একের পর এক রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে। অনেক রেস্টুরেন্ট খাবার বদলে উঠতি বয়সিদের আড্ডা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
খিলগাঁও : তালতলা সিটি করপোরেশন সুপার মার্কেটের পাশে ১০ তলা স্কাই ভিউ নাজমা টাওয়ার পুরোটাই রেস্টুরেন্ট। ডেঞ্জার, লাঞ্চ ডি নোভো, পিজ্জা টাউন, টাইম স্কয়ার ডাইন, রকারেজ কফি ইত্যাদি হরেক নামের বাহার। অথচ ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি থাকায় ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটলেও বড় বিপদের শঙ্কা রয়েছে।
খিলগাঁও তালতলা সুপার মার্কেটসংলগ্ন কপোতাক্ষ জে. এফ টাওয়ারের দশতলা ভবনের নিচে শাহিন স্পাইসি কাবাব রেস্টুরেন্ট। এর শীতাতপ যন্ত্রের (এসি) নিচেই মাংস গ্রিল করার ব্যবস্থা। এতে যে কোনো সময় এসি বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়া মালিবাগ মোড়ের একটি ১৩ তলা ভবনের অর্ধেক রেস্টুরেন্ট, বাকিটা আবাসিক। স্থানীয়দের কাছে ভবনটি কেএফসি ভবন নামে পরিচিত। ভবনে কেএফসি, ডমিনোস পিজা, ক্রিমসন কাপসহ আল কাদেরিয়া এক্সপ্রেস অ্যান্ড পার্টি সেন্টারের সাইনবোর্ড দেখা যায়।
স্থানীয় বেলাল মিয়া বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় আগে থেকেই এ এলাকায় রেস্টুরেন্টের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে নতুন করে তৈরি ভবনগুলোতেও বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট তৈরি হচ্ছে। এছাড়া ভাড়া বেশি হওয়ায় ভবন মালিকরাও রেস্টুরেন্টের কাছে ভাড়া দিতে আগ্রহী। এতে ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র রেস্টুরেন্ট তৈরি হচ্ছে।
উত্তরা : ১২ নম্বর সেক্টরে শাহ মখদুম এভিনিউসংলগ্ন একটি ৬ তলা আবাসিক ভবনের চারটি ফ্লোরেই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চলছে। প্রতিটি রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরেই চুলার পাশে আছে বিশাল সাইজের গ্যাস সিলিন্ডার। একই অবস্থা উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টর এলাকায়। সোনারগাঁও জনপদ রোডের কয়েকটির বাড়ির পুরোটাই রেস্টুরেন্ট। একটি ভবনে আছে বেইলি রোডের সেই ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্টে’র শাখা। ফায়ার সার্ভিসের উত্তরা স্টেশনের কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় অনেক ভবনেই যথাযথ ফায়ার সেফটি নেই। এমনকি বিএনএস সেন্টার, রাজউক কমার্শিয়াল, নর্থ টাওয়ার, রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স ও রাজলক্ষ্মী টাওয়ারের মতো বড় ভবনগুলোতেও অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
এদিকে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা পরিদর্শন করা হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া হবে। এরপরও প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সেখানে সতর্কতার নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে ফায়ার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।