ইরান-ইসরাইল সংঘাত: কোন দিকে যাবে জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজার?

ইরান-ইসরাইল সংঘাত: কোন দিকে যাবে জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজার?

আন্তর্জাতিক

অক্টোবর ৬, ২০২৪ ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ

মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনও ভূরাজনৈতিক সংকট ও উত্তেজনার সঙ্গে যে পণ্যটির নাম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে তার নাম জ্বালানি তেল। ইসরাইল, গাজা, লেবানন ও ইরানকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া মধ্যপ্রাচ্যের এবারের সংকটেও তাই ঘুরে ফিরে আসছে এ বিষয়টি। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ সত্যিই বেধে গেলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জ্বালানি তেলের দাম? আবার ব্যারেলপ্রতি দাম কি একশ ডলারে উঠবে?

প্রথমে গাজায় বর্বর সামরিক হামলা, এরপর ইরানে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই হিজবুল্লাহ প্রধানহাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল। নিজেদের মিত্রদের প্রতি এই ইসরাইলি হামলার জবাবটা অবশ্য শক্তভাবেই দিয়েছে ইরান। ইসরাইলি ভূখণ্ড বিশেষ করে দেশটির সবচেয়ে বড় শহর তেলআবিবে নজিরবিহীন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরান।

হামলার পরপরই ইরান ও ইসরাইল মুখোমুখি সংঘাত শুরুর প্রমাদ গোণে পুরো বিশ্ব। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম সামান্য বৃদ্ধি পেলেও তা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) ইসরাইলে ইরানি হামলার পরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ২ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। তবে যুদ্ধ বেধে গেলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি সত্যিই একশ ডলারে উঠবে কি না, কিংবা কোন পরিস্থিতিতে তা একশ ডলারে পৌঁছাতে পারে সেটিই এখন জ্বালানির বাজারে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

জ্বালানির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ইরান

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে বিশ্বের জ্বালানির বাজারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ইরান। বর্তমানে দেশটি দিনে গড়ে প্রায় ৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪ শতাংশ। পক্ষান্তরে সৌদি আরবের দৈনিক উৎপাদন ৯ মিলিয়ন ব্যারেল।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের তেল উৎপাদন ও রফতানি সক্ষমতায় ব্যাঘাত হলেও তা তেহরানকে বিশ্ববাজার থেকে ছিটকে ফেলতে পারেনি। বরং বরাবরই রফতানির জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে নিয়েছে ইরানি তেল। বিশেষ করে চীন পরিণত হয়েছে ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় গন্তব্যে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দিনে ২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রফতানি করে তেহরান।

যে কারণে ইসরাইলে ইরানি হামলার প্রভাব পড়েনি তেলের বাজারে

এ পরিস্থিতিতে ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিশ্বের তেলের বাজারে অস্থিরতার আভাস দেয় অনেকেই। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের অতীত সংঘাতের ইতিহাসের আলোকে তেমনটাই ঘটার আশঙ্কা করেছিলেন অনেকে। তবে বাস্তবে তেলের দামের সামান্য উল্লফন ছাড়া তেমন কিছুই ঘটেনি। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত দুই তিন দশকে বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহের কাঠামোতে পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই।

এক সময় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে থাকলেও বিগত বছরগুলোতে সেই নির্ভরশীলতায় পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের শেল জ্বালানির আবির্ভাবে পরিস্থিতির বদলে গেছে অনেকটাই। বিপুল পরিমাণ এই শেল জ্বালানির বরাতে বর্তমানে এক সময়ে জ্বালানির সবচেয়ে বড় আমদানিকারক পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানি উৎপাদকে। এ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরতা অনেকখানিই হ্রাস পেয়েছে ওয়াশিংটনের।

ফলে ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা তেলের বাজারে খুব একটা প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। এ ব্যাপারে সিএনএনকে আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটের গ্লোবাল হেড অব কমোডিটি স্ট্রাটেজি হেলিমা ক্রফট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শেল জ্বালানি বিপ্লবের আগে এই ধরনের পরিস্থিতিতে তেলের দাম সহজেই ১০০ ডলারে উঠে যেত।

তবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যে জ্বালানি তেলের দামের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না সেটাও বলা যাচ্ছে না, কারণ বছরদুয়েক আগে ইউক্রেনে রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পরপরই তেলের দাম রাতারাতি ১৩০ ডলারে পৌঁছেছিল। অবশ্য পরবর্তীতে এই যুদ্ধ বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে না পারায় তেলের দাম ফের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এখন প্রশ্ন হলো ইরান ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হলে সত্যিই কি তেলের বাজারে এর প্রভাব পড়বে না, আর পড়লেও তার প্রভাব হবে কতখানি, কিংবা যুদ্ধ শুরু হলে দাম প্রতি ব্যারেল কত ডলারে উঠবে?

ইসরাইলের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে তেলের দাম

ইসরাইলের তেলআবিব নগরীসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় দুই শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এর উপযুক্ত জবাব দেয়ার হুমকি দিয়েছে ইসরাইল। এখন ইসরাইলের জবাব কোন মাত্রার হবে, তার ওপর নির্ভর করতে পারে তেলের দামের ওঠানামা। তবে সিএনএনের মতে, ইসরাইলকে ইরানে এমন হামলা চালাতে নিরূৎসাহিত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, যার প্রতিক্রিয়ায় বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে।

এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত বুধবার (২ অক্টোবর) ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ইরানের হামলার জবাবে দেশটির পরমাণু স্থাপনায় ইসরাইলি হামলাকে সমর্থন করবে না ওয়াশিংটন।

এ ব্যাপারে সিএনএনকে রাপিডান এনার্জি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট বব ম্যাকনেলি বলেন, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সংঘাতের তীব্রতা বেড়ে গেলে তা জ্বালানি অবকাঠামো এবং তেলের সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলবে।

হেলিমা ক্রফট সিএনএনকে বলেন, এ অবস্থায় ইসরাইল যদি ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোয় হামলা চালায় তাহলে ইরান এই সংঘাতকে পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে যেন এর প্রভাব আন্তর্জাতিক স্তরেও অনুভূত হয়। এ বিষয়ে ২০১৯ সালে সৌদি আরবের জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলার প্রতিক্রিয়ায় তেলের দাম রাতারাতি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।

ইরানের তেল অবকাঠামোর ওপর হামলা বাড়িয়ে দেবে দাম

ইসরাইল যদি ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর হামলা চালায় তাহলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৪ ডলার থেকে রাতারাতি বেড়ে ৮৬ ডলারে উঠে যেতে পারে বলে নিজেদের গ্রাহকদের জানিয়েছে জ্বালানি বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্লিয়ারভিউ এনার্জি পার্টনার্স। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কেভিন বুক এ ব্যাপারে সিএনএনকে বলেন, জ্বালানির বাজার বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের ঝুঁকির ওপর নির্ভর করছে।

বিশেষ করে ইসরাইল যদি খার্গ আইল্যান্ডে অবস্থিত ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা চালায়। এতে ইরানের তেল সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছে ক্লিয়ারভিউ। কারণ ইরানের তেল রফতানির ৯০ শতাংশ স্থাপনা এই দ্বীপে অবস্থিত। ফলে দৈনিক প্রায় দুই মিলিয়ন ব্যারেল তেল সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হবে বৈশ্বিক বাজার, যার প্রভাব অবশ্যই অনুভূত হবে তেলের দামে।

হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তেলের দাম উঠবে ১০০ ডলারে

তত্ত্বগতভাবে দেখলে বিশ্ববাজারে ইরানের তেল সরবরাহ বন্ধ হলেও তা শেষ পর্যন্ত পুষিয়ে নিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র আরব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো। সেক্ষেত্রে নিজেদের উৎপাদন বাড়িয়ে নেবে তারা। এ ব্যাপারে হয়তো তেলের উৎপাদন বাড়ানোর যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ ফেলতে পারবে না সৌদি আরব। এমনকি সাময়িকভাবে নিজেদের কৌশলগত জ্বালানি ভান্ডার থেকেও বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহ করতে পারে ওয়াশিংটন, যেমনটা তারা করেছিল ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর।

এক্ষেত্রে তেলের বাজার খুব বেশি অস্থিতিশীল হয়তো হবে না। কিন্তু আসল বিপদ হবে তখন, যদি ইরান নিজেদের তেল অবকাঠামোতে ইসরাইলি হামলার জবাবে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেক্ষেত্রে পুরো পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, যার প্রভাবে ভুগতে হবে পুরো বিশ্বকেই। মাত্র ২১ মাইল প্রশস্ত হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে বের হওয়ার একমাত্র পথ, যার একধারে অবস্থিত ইরান।

ইরান চাইলেই হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে, তার সেই সামরিক সক্ষমতাও রয়েছে। এতে ইরাক, কুয়েক, আরব আমিরাত ও কাতারের জ্বালানি রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্র তেলের দাম সত্যি সত্যিই ১০০ ডলারের উপরে উঠে যেতে পারে বলে মনে করছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্লিয়ারভিউ। এবং এই দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সংকটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সিটিগ্রুপ গত বুধবার তার গ্রাহকদের জানিয়েছে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে তা বৈশ্বিক জ্বালানির বাজার ও অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজার ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যার ফলে তেলের দাম আকস্মিকভাবে এত দ্রুত বেড়ে যেতে পারে, যা অতীতের সব দামের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *