সন্ধ্যায় বিক্রেতারা যখন তাদের অস্থায়ী দোকান ও স্টলগুলো গুটিয়ে নেন, মিনা চৌধুরী তখনই তাড়াহুড়ো করে হাটে চলে যান। বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর ‘ফেলনা সবজি-তরকারি’ ভ্যানে-স্টলে পড়ে থাকে। কম দামে সেগুলো কিনে বাড়িতে নিয়ে আসেন।
হয়তো এসব সবজি আধপচা, কেবল কোনো কোনো অংশ খাওয়ার যোগ্য। কিন্তু তাতে মিনা চৌধুরীর কিছু যায়-আসে না। ফেলনা তরকারিগুলো দিয়েই তিনি খাবার রান্না করেন। খাদ্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দামে পরিবারের চাহিদা মিটাতে এর বিকল্প তার সামনে নেই।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি কৌশল বেছে নেন ৪৮ বছর বয়সী এই নারী। তার মধ্যে একটি হচ্ছে মরা-হাটে গিয়ে ফেলনা শাক-সবজি ও তরকারি কিনে নিয়ে আসা।
গেল দুই বছরে মিনা চৌধুরীর পরিবারের খাদ্যতালিকায় নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। ভোজ্য তেল খরচে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকেন। এমনভাবে রান্না করেন, যাতে এক লিটার তেল দিয়ে দুই সপ্তাহ চলে যায়। খাবার খরচ কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন।
আর ফল, গোশত নাগালের বাইরে। কালেভদ্রে এসব খাবার তারা মুখে পোরেন। এমনকি সাধারণ ডিমও সংকোচিত খাদ্যতালিকা থেকে উধাও হয়ে গেছে।
ভারতের রাজধানীর নয়াদিল্লির দক্ষিণাঞ্চলের জাগদম্বা ক্যাম্পের নিজের ছোট্ট বাসায় বসে কথা বলছিলেন মিনা চৌধুরী। স্বামী ও তিনসন্তান নিয়ে তিনি সেখানে থাকেন। বললেন, আমার মেয়ে বিউটিশিয়ান প্রশিক্ষণ ক্লাসে বাসা থেকে যে লাঞ্চবক্স নিয়ে যায়, তা নিয়ে তাকে অনেক লজ্জিত থাকতে হয়। সহপাঠীরা যদি দেখে ফেলে, তাহলে তারা কী মনে করবে—তা ভেবেই তটস্থ থাকে মেয়ে।-খবর আল-জাজিরার
দিল্লির আম্বেদকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক দীপা সিং বলেন, মুদ্রাস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে। খাদ্যতালিকায়ও লেগেছে সেই ধাক্কা। নিজেদের প্রয়োজনগুলো তারা কমিয়ে ছোট করে ফেলেন।
এতে পরিবারগুলো কেবল স্বল্পাহারই করেন না, খাবারে পদের সংখ্যাও কমে গেছে। ফলে খাদ্যবৈচিত্র্য ও পুষ্টি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। প্যান-ইন্ডিয়া রাইট টু ফুড ক্যাম্পেইনেও সক্রিয়া দীপা। তিনি বলেন, আমাদের মাঠ পর্যায়ের জরিপে দেখা গেছে, ডাল-তেল-প্রোটিন ও পচনশীল খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন লোকজন। এসব খাবার তাদের বরাদ্দের বাইরে। সরকারি-ভর্তুকি খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে মানুষ।
মার্চে ভারতে খুচরা পণ্যে মুদ্রাস্ফীতি সাত শতাংশ বেড়েছে। গেল সতেরো মাসের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। এতে খাদ্যমূল্য অভাবনীয় বেড়েছে—আগের বছরের চেয়ে সাত দশমিক সাত শতাংশ।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপে বিশ্বজুড়ে বেড়েছে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্য। এতে মিনা চৌধুরীদের মতো পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। মুদি পণ্যের দাম এখনো অনুকূল থাকলেও তাতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
যুদ্ধের কারণে গম রফতানি কমে গেলে তা পূরণে চেষ্টা করছে ভারতীয় সরকার। ২০২২-২৩ সালে ভারতের গম রফতানি রেকর্ড স্পর্শ করতে পারে। গেল মার্চে অস্তস্তিকর গরমে গম উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমে গেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ঘাটতিতে রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে ভারত সরকার।
অভ্যন্তরীণ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে বিশ্বের বহু দেশ। ব্যাপক রফতানি আয় সত্ত্বেও তাতে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হচ্ছে সরকারকে। গেল বছরে সার রফতানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল চীন। কিন্তু এবার দেশটির রফতানিতে হিড়িক পড়েছে। আবার ভোজ্য তেল উৎপাদনের নেতৃত্ব দেওয়া ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনার মতো কিছু দেশ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাদের। ন্যাশনাল কমোডিটিজ ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রধান ও কারগিল ইন্ডিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজ চৌধুরী বলেন, পরবর্তী সময়ে আরও বড় আকারে রফতানিতে আগ্রাহী ভারত। রফতানিতে আগ্রহ থাকায় দেশের খাদ্য মজুদে ধস নামতে পারে। সরকার-পরিচালিত খাদ্য প্রকল্পেও পড়বে নেতিবাচক প্রভাব।
অনিশ্চিত পরিস্থিতি
ভারতে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া খাদ্য কর্মসূচিতে রয়েছেন আট কোটি মানুষ। মহামারিতে ভয়াবহ ক্ষুধা ও অনাহার থেকে রক্ষা করতে সরকার তাদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। রাইট টু ফুড ক্যাম্পেইনের দীপা সিং বলেন, খাদ্যশস্যের ঘাটতির কারণে সরকার যদি বিনামূল্যের খাদ্য কর্মসূচি থেকে সরে আসে, যা আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলার কথা, তাতে এটিই প্রমাণিত হবে যে, ভারতের খাদ্য উদ্বৃত্তের কথা আসলে গল্প। তাতে কোনো সত্যের ছোঁয়া নেই।
সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে কেবল অনিশ্চয়তার কথাই বলছে। ফেব্রুয়ারিতে রাইট টু ফুড ক্যাম্পেইনের ‘হাঙ্গার ওয়াচ’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবারের রান্নার গ্যাস কেনার সামর্থ্য নেই। খাবার এড়িয়ে যাওয়া খুবই সাধারণ বিষয়। গড়ে দুটি পরিবারের মধ্যে একটি পর্যাপ্ত খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না।
১৪টি রাজ্যের সাড়ে ছয় মানুষের ওপর জরিপ করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। গেল মার্চে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে দেখা গেছে, দশ শ্রমিকের মধ্যে অন্তত চারজন গত দুই বছর ধরে বেকার। ২০২০ সালের মার্চে করোনা প্রতিরোধে ভারতে লকডাউন ঘোষণার পর থেকে তারা কর্মহীন।
প্রযুক্তির কেন্দ্রস্থল বেঙ্গালুরুর তিন হাজার পরিবারের ওপর জরিপটি চালানো হয়েছে। বিস্ময়কর হলেও চল্লিশ শতাংশ পরিবার মহামারির আগের সময়ের চেয়ে কম খাবার খাচ্ছে। আর এক চতুর্থাংশ বিভিন্ন উৎস থেকে খাবার ধার করেছে। কেউ কেউ প্রয়োজন মেটাতে স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি কিংবা পন রেখে এসেছেন।
আসছে দিনগুলোতে মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা মিনা চৌধুরীর মতো পরিবারগুলোকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। অন্ধকারে ঢাকা সরু গলির ভিতরে নড়বড়ে লোহার সিঁড়ি বেয়ে তাদের বাসায় যেতে হয়। একটি কক্ষ আর রান্নাঘর মিলিয়ে বাসাটিতে আলো পৌঁছানো দায়।
সরু লেনের ক্যাম্পে ঢুকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। ম্যাচবক্সের মতো দুই পাশে বাড়িগুলো সাজানো, যাতে অস্থায়ী শ্রমিকেরা থাকেন। শহরের অভিজাত মহল্লাগুলোতে তারা কাজ করেন।
মিনা চৌধুরীর স্বামী নিজের চাকরি থেকে মাসে ১০ হাজার রুপি আয় করেন। তিনি একজন নিরাপত্তা প্রহরী। করোনা মহামারি আঘাত হানার আগেও তার উপার্জন এমনটিই ছিল। তাদের ১৯ ও ২২ বছর বয়সী দুটি সন্তান আছে। গেল কয়েক বছর ধরে তারা হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে।
সবার আয় কমে যাওয়ায় খাদ্যতালিকা থেকে বাড়িতে তৈরি পিঠাপুলি ও মিষ্টান্ন বাদ দিতে হয়েছে। বাসায় মেহমান এসে কয়েকদিন থাকলে খরচের হিসাব নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয় তাদের। খুবই সতর্কতার সঙ্গে তারা সওদা করেন। কিন্তু অধিকাংশ মাসগুলোতে ২০ তারিখের পরে তাদের হাতে কোনো পয়সা থাকে না।
এতে বন্ধু ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার কিংবা সহায়তার জন্য হাত পাততে তারা বাধ্য হন। কখনো-কখনো পরিবারে সামান্য সঞ্চয় থাকলেও তা ধরে রাখতে পারেন না। অসময়ে খরচ করে ফেলতে হয়।
ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি
বাজার পর্যবেক্ষণকারী সিআরআইএসআইএলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ধর্মক্রিতি জোশি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এতে খাদ্য মূল্যবৃদ্ধি একটি বড় সমস্যা হয়েই থাকল। আর সরবরাহেও ব্যাপক উত্থান-পতন দেখা গেছে।
তিনি বলেন, খাদ্য ও সারে ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বাজেটে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এখন ব্যাপক ও বিস্তৃত রূপ নিয়েছে। আরও আরও পণ্যের ওপর তার প্রভাব পড়ছে। এর বিরূপ ফলও বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। ১০টি ভারতীয় পরিবারের মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দেওয়া খাবারের ওপর নির্ভরশীল।
গম, ভুট্টা ও বার্লির দাম বাড়ায় ভূমিকা রাখছে খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতি। এতে রুটি, পোল্ট্রি, দুধ থেকে শুরু করে বিস্কুট ও বিয়ারের দামেও প্রভাব ফেলছে। হঠাৎ করেই ভোক্তারা বড় ধরনের খরচের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ভোজ্য তেলের দামও ঊর্ধ্বমুখী। হায়দারাবাদভিত্তিক কৃষিপণ্য সরবরাহকারী ‘আওয়ার ফুডের’ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরশাদ পেরওয়াজ বলেন, ভোক্তা চাহিদা না-কমলে কৃষিপণ্যের খুচরা বাজারেও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে। এরআগে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালেও খাদ্যমূল্য বেড়েছিল। তখন চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল, পাশাপাশি কমে গিয়েছিল সরবরাহ। বর্তমানে সামগ্রিক চাহিদা দৃশ্যত দুর্বল।
জাগদম্বা ক্যাম্পের মতো স্থানগুলোতে পরিস্থিতি খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। সুরিয়া কালি নামের ৪৩ বছর বয়সী এক নারী বলেন, মহামারির আগে তিনি নিয়মিত দুই লিটার করে দুধ কিনতেন। কিন্তু বর্তমানে ১০ রুপিতে ২০০ মিলিগ্রামের প্যাকেট কেনেন।
দুই সন্তানের এই মা আরও জানান, ফল ও মুরগির মাংস কিনতে ইচ্ছা করে। কিন্তু স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার মেয়ে যখন এক গ্লাস আখের রস কিনতে অনুরোধ করে, তার সেই ইচ্ছাও আমি পূরণ করতে পারি না। বরং এতে ঠাণ্ডা লাগবে বলে তাকে বুঝ দিই।
খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বহু মানুষকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত কৌশিলিয়া দেবী নামের এক বিধবা চিকিৎসকের দেওয়া খাদ্যতালিকা মেনে চলতে পারছেন না। এতে তাকে দৈনিক তিন গ্লাস দুধ পানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কাজের খোঁজে নয়াদিল্লিতে আসার কারণে সরকারি ভর্তুকির খাদ্য প্রকল্প থেকেও তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
গেল সপ্তাহে তপ্ত গরমের মধ্যে নিজের ও তিন সন্তানের জন্য একটি পাতিলে রান্না করতে দেখা গেছে তাকে। পিঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, কয়েক চিমটি লবণ ও অল্প কয়েক চা চামুচ তেল দিয়ে তিনি পোলাও রান্না করছিলেন। এতে সামান্য কিছুটা মাংস, মসলা, সবজি ও চর্বি ব্যবহার করতে দেখা গেছে।