এপ্রিল ২৪, ২০২২ ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ
প্রায় ৩ দশক আগে মায়ের কোলে চড়েই গ্রাম ছাড়েন ৫ বছরের মামুন মাতব্বর। শুধু মামুনই নয়, অভাব মেটাতে বড় ছেলে মিজান ও মেজ ছেলে নিজামকে সঙ্গে নিয়ে আব্দুল হাইও গ্রাম ছেড়ে পটুয়াখালী শহরে যেতে বাধ্য হন। আব্দুল হাই শহরের এক মসজিদে ইমামতি শুরু করলেও বড় ছেলে মিজান চলে যান যশোরে। সূত্র বলছে, মিজান মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বয়সের পরিক্রমায় মামুন চলে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মামুনের চাচা আলতাফ মাতব্বর বলেছেন, আজ থেকে ৩০ বছর আগে মামুন তার পরিবারের সঙ্গে পটুয়াখালী শহরে যায়। মামুনের বয়স তখন ৫-৬। স্থানীয় দক্ষিণ টেপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। মামুনের বড় ভাই মিজান ঢাকায় এক শিল্পপতির সন্তান অপহরণ মামলায় জেল পলাতক আসামি। মামুনসহ তিন ভাইয়ের জন্ম দক্ষিণ টেপুরা গ্রামের মাতব্বর বাড়িতে হলেও সেখানে তাদের কোনো সহায়-সম্বল নেই বলে স্বজনদের দাবি। মামুনের বাবা সহজ-সরল ও একরোখা হলেও মা মমতাজ বেগম ছিলেন কূটকৌশলী।
স্থানীয়দের দাবি, মায়ের আশকারায় মিজান-মামুন অপরাধ জগতে পা রাখেন। মামুন মাঝেমধ্যে বাড়িতে গেলেও অন্যরা কখনো যায়নি। প্রায়ই পুলিশের স্টিকার লাগানো সাদা প্রাইভেট কার অথবা পাজেরো নিয়ে এলাকায় মহড়া দিতে আসত মামুন। মাথায় টুপি লম্বা দাড়িতে মামুনের সিগারেট টানার স্টেইলে বিস্মিত হতো গ্রামবাসী। গাড়ি চালককে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন এটা সার্কেল এসপি স্যারের গাড়ি।
এলাকাবাসী বলছেন, পটুয়াখালী শহরে ছোট সময়ে তিন ভাই-ই লঞ্চের কেবিনে বয়ের কাজ করত। পরে দেখি মিজান যশোর থেকে পটুয়াখালীতে এসে বড় চৌরাস্তায় ডেন্টিং-পেইন্টিংয়ের দোকান দিয়ে চোরাই মোটরসাইকেলের ব্যবসা শুরু করে। এছাড়াও ঢাকা-পটুয়াখালী লঞ্চ রুটে মাদক বহন, যানবাহনের জাল সনদ এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ সব জালিয়াতিতে মিজানের দক্ষতা ছিল। মিজানের হাত ধরে রাজধানীর ক্যাডার বাহিনীতে যুক্ত হয়ে পুলিশের গুলিতে মামুনের ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে হাঁটেন তিনি। এখনো শুনি অপহরণের ঘটনায় মামুন ধরা খাইছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে ২০১৫ সালের ২ মে রাজধানীর বনানী থেকে টিএনজেড গ্রুপের মালিক শাহাদাত হোসেনের ৮ বছরের শিশু সন্তান আবিরকে অপহরণ করে ১০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে করে মামুনের বড় ভাই মিজানুর রহমান মাতব্বর ও তার সঙ্গীরা। অনেক দেনবারে ৬ মে তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৭৩ লাখ টাকা অপহরণকারীদের ব্যাংক হিসাবে দেওয়া হয়। একই দিনে হোটেল র্যাডিসনের সামনে অবস্থান করে নগদ ২৭ লাখ টাকা নিয়ে শিশুটিকে ফিরিয়ে দেয় তারা। ১৭ মে মিজান পটুয়াখালী মার্কেটাইল ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে এলে ওঁৎ পেতে থাকা র্যাবের বিশেষ টিম তাকে গ্রেফতার করে। ১৮ মে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় এ ঘটনায় মামলা হয়। ওই মামলায় ২০১৯ সালের ১৬ মে ল্যাংড়া মামুনের ভাই মিজানসহ দুজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৮ আসামিকে যাবজ্জীবন দেয় ঢাকার সাত নম্বর নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. খাদেম উল কায়েস। পরে মিজানুর রহমান মাতব্বর ভুয়া জামিননামায় আদালত থেকে বের হয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। মিজান জেল থেকে পালানোর পর প্রায়ই বাড়িতে পুলিশ আসত। অপরদিকে মামুনের এক বিশ্বস্ত সূত্র বলে, মিজানুর রহমান জেল থেকে পালিয়ে তাৎক্ষণিক পটুয়াখালীতে পৌঁছে মামুনের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ১০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এরপর কী হয়েছে আমার জানা নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর শিল্পপতির ছেলে অপহরণ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৮ জনের মধ্যে আশিকুর রহমান ওরফে কাউসার মৃধাও একজন। পটুয়াখালীতে অপহরণকাণ্ডে জড়িত গাড়িচালক বিআরটিসি জসিম মৃধার আপন ছোট ভাই এই আশিকুর রহমান ওরফে কাউসার মৃধা।
মামুনের চাচাত ভাই ওয়াসিম মাতব্বর বলেন, ছোটবেলা থেকে বাড়ি ছাড়ার পর প্রায় দুই বছর আগে মামুন ঘন ঘন বাড়িতে আসত। আমতলীর থানা ওসির সঙ্গে মামুনের সখ্য থাকায় একটি মাদক মামলায় আমাকেও ফাঁসিয়েছেন। এলাকায় পুলিশের গাড়ি নিয়ে এসে দম্ভোক্তি দেখাত। মামুন অপরাধ জগতে আসার কারণ জানতে চাইলে ওয়াসিম বলেন, মামুনের বড় ভাই মিজানের হাত ধরেই মামুন এ জগতে এসেছে। ভাইদের মধ্য মিজান-মামুনের ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রখর। সব অপকর্মে দুই ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা অটুট ছিল। মিজান কোথায় আছে তা ও মামুনই জানে। মামুনের ভাই মিজান কোথায় আছে জানে না এলাকার কোনো মানুষ। কখনো তিনি এলাকায়ই আসেননি। তবে মিজান ঢাকার একটি অপহরণ মামলায় অনেক বছর অগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন বলে জানান এলাকার এক সাবেক জনপ্রতিনিধি। ভুয়া জামিন নামা তৈরি করে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি লাপাত্তা বলে জানান মামুনের এক চাচা। মামুনের বাবা-মা থাকেন পটুয়াখালীতে মামুনের বাসায়। মামুনের ছোট ভাই নিজাম বিদেশে থকেন বলে জানান তাদের এক প্রতিবেশী প্রবাসী। মামুনের বোনের অন্যত্র বিয়ে হয়েছে বলে জানান চাচাত ভাই ওয়াসিম।
হলুদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিন্টু মল্লিক জানান, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে মামুনকে আমি চিনি। পটুয়াখালীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিবু লাল দাশ অপহরণ ও ২০ কোটি টাকা মুক্তি পনেরো ঘটনার পরপরই পুলিশ র্যাব মামুনের হলুদিয়ার বাড়িতে বারবার অভিযান চালায় এবং প্রশাসনের লোকজন বিভিন্নভাবে আমার মাধ্যমে খোঁজখবর নিলে আমরা জানতে পারি মামুন এত বড় সন্ত্রাসী।
ঘটনার বরাত দিয়ে পটুয়াখালীর এসপি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণের আশায় গত ১১ এপ্রিল পটুয়াখালী শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিবু লাল দাস ও তার গাড়ি চালক মিরাজকে অপহরণ করে মামুন ও তার সহযোগীরা। ১২ এপ্রিল রাতে শহরের এসপি কমপ্লেক্স থেকে বস্তাবন্দি মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে পটুয়াখালীর পুলিশ। ১৯ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটনের গোয়েন্দা পুলিশ ওই অপহরণকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড মামুন মাতব্বর ও তার সহযোগী পিচ্চি রানা, জসিম উদ্দিন এবং আশিকুর রহমানকে রাজধানীর মিরপুর, ভাটারা এবং গুলিস্তান এলাকা থেকে আটক করে। এখন পর্যন্ত ১১ জন আটক হয়েছে। বাকি পলাতকদের খুঁজছে পুলিশ।