বাবা-মায়ের জেদের শিকার দুই শিশু, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

বাবা-মায়ের জেদের শিকার দুই শিশু, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

জাতীয় স্লাইড

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩ ৯:১১ পূর্বাহ্ণ

দুই শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব চেয়ে জাপানি মা এবং বাংলাদেশি বাবার আইনি লড়াই এখনো শেষ হয়নি। তারা এক আদালত থেকে অন্য আদালতে দুই সন্তানকে নিয়ে ছুটছেন। জেদের কারণে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। দুই বছর ধরে বাংলাদেশের আদালত চত্বরেই ঘুরপাক খাচ্ছে দুই শিশুর ভাগ্য। এমন অবস্থায় সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। মানসিক চাপসহ নানা অজানা ভয় তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত বিষয়টির নিষ্পত্তি না হলে মা-বাবার জেদের প্রভাব পড়বে সন্তানদের ওপর।

জাপানের নাগরিক এরিকো এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমরান শরীফ দুই শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব চেয়ে ২০২১ সাল থেকে পালটাপালটি মামলা করে আসছেন। সর্বোচ্চ আদালত হয়ে সর্বশেষ ২৯ জানুয়ারি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান শিশুদের জিম্মা চেয়ে বাবা ইমরান শরীফের মামলা খারিজ করে রায় দেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে পরদিন ইমরান শরীফ ঢাকা জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ইমরান শরীফের করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন আদালত। একই সঙ্গে দুই সন্তান কার সঙ্গে থাকবে, সেই বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতার তাগিদ দেন আদালত।

এদিকে জাপানি মা এবং বাংলাদেশি বাবার আইনি লড়াই কোনদিকে গড়ায়, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। আদালতের দিকেই তাকিয়ে আছেন সবাই। আদালতের সিদ্ধান্তেই এর সুন্দর সমাধান হবে বলে তারা মনে করছেন।

শিশুদের বিষয়টি খুবই অমানবিক উল্লেখ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এটা দ্রুত সমাধান করা দরকার। আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, সবাইকে মেনে নিতে হবে। তিনি বলেন, মা-বাবার জেদের কারণে বাচ্চাদের জীবন এখন ঝুঁকিতে। মা-বাবা দুজনকে বলব, অন্তত সন্তানের দিকে তাকিয়ে একটা সুন্দর সমাধানে যাওয়া দরকার। নাহলে শিশুদের ভবিষ্যৎ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, বিষয়টির আরও আগেই সমাধান হওয়া উচিত ছিল। এটা আমাদের বিচারব্যবস্থার ব্যর্থতা। দুই বছর ধরে শিশুদের নিয়ে মা-বাবা আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। পারিবারিক মামলা দ্রুত সমাধান করতে হবে।

সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না যুগান্তরকে বলেন, দুই শিশুকে নিয়ে জাপানি মা এবং বাংলাদেশি বাবার আইনি লড়াই চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। এটি একটি পারিবারিক কলহ। এক আদালত থেকে অন্য আদালতে তারা ঘুরছেন। আদালত, থানা, সেফ হোম ইত্যাদি জায়গায় যেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাচ্চাদের একদিকে পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি করছে। এটা দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার। মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুই শিশুকে কোনো একটি পরিবারের জিম্মায় দেওয়া যেতে পারে। যাতে করে তারা স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে।

মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি ছাড়া বিকল্প নেই। এছাড়া মা-বাবা দুজনকেই কাউন্সেলিং করা দরকার। বিষয়টি অতিদ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন বলে মনে করেন শিশুদের মায়ের আইনজীবী শিশির মনির। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বাচ্চাদের জাপান থেকে বাংলাদেশে এনে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো, এতে শিশুদের অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন হয়েছে। আমি মনে করি, শিশুদের এই মানসিক অস্বস্তির জন্য মা-বাবা উভয়েই দায়ী। শিশুদের লেখাপড়ায় ফেরত যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হোক। তিনি বলেন, ১৬ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ইমরান শরীফের করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন আদালত। ২ মার্চ সেটি শুনানির জন্য রয়েছে। আদালত বলেছেন, এরই মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য উভয়পক্ষ যেন বসার চেষ্টা করে।

জাপানের নাগরিক এরিকো এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমরানের ২০০৮ সালের ১১ জুলাই বিয়ে হয়। তাদের তিনটি কন্যাসন্তান আছে। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি এরিকোর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন ইমরান। এরপর ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়ে (বড় ও মেজো) জেসমিন মালিকা (১২) ও নাকানো লায়লাকে (১১) নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। ছোট মেয়ে জাপানে আছে। ইমরানের কাছ থেকে দুই মেয়েকে ফিরে পেতে ঢাকায় এসে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে একটি রিট করেন নাকানো এরিকো। অন্যদিকে ছোট মেয়েকে ফিরে পেতে পৃথক একটি রিট আবেদন করেন ইমরান।

পৃথক রিটের ওপর শুনানি নিয়ে দুই শিশু তাদের বাবা ইমরানের হেফাজতে থাকবে বলে ওই বছরের ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট আদেশ দেন। এ আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন এরিকো। এরিকোর করা আবেদন (লিভ টু আপিল) নিষ্পত্তি করে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। আদেশে বলা হয়, ঢাকার পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাটি (২০২১ সালে শিশুদের বাবার করা) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাপান থেকে আসা দুই শিশু তাদের মায়ের হেফাজতে থাকবে। শিশুদের বাবা তাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন।

আদেশে আরও বলা হয়, মামলার পারিপার্শ্বিক বিষয় ও শিশুদের স্বার্থ বিবেচনায় তাদের এই আদালতের এখতিয়ারের বাইরে (দেশের বাইরে) নেওয়া যাবে না। আপিল বিভাগের আদেশের অনুলিপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতকে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে ২ মেয়েকে নিয়ে জাপান যেতে চাইলে বিমানবন্দর থেকে ইমিগ্রেশন পুলিশ ফেরত পাঠায় এরিকোকে। ওইদিন থেকে মেজো মেয়ে লায়লা বাবা ইমরান শরীফের হেফাজতে রয়েছে। এরই মধ্যে ২৯ জানুয়ারি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান শিশুদের জিম্মা চেয়ে বাবা ইমরান শরীফের মামলা খারিজ করে রায় দেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে পরদিন ইমরান শরীফ ঢাকা জেলা জজ আদালতে আপিল করেন।

এদিকে আদালতের রায় অমান্য করে জাপানি মা নাকানো এরিকোও দ্বিতীয়বারের মতো তার বড় মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে ৩১ জানুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ত্যাগের চেষ্টা করেন। রাত পৌনে ১২টার দিকে তাদের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। এ ঘটনার পর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গুলশান থানা থেকে মেজো মেয়ে লায়লাকে তার মা নিতে চাইলে সে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে। একপর্যায়ে সে টেবিলের নিচে গিয়ে লুকায়। পড়ে মা বড় মেয়েকে নিয়ে থানা ত্যাগ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *