রাজধানীতে ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। প্রতিদিন ১২-১৫ জন আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এর বাইরেও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন, যারা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি, তাদের সংখ্যা বহুগুণ।
ডেঙ্গি প্রতিরোধ, বংশবিস্তার ও প্রজনন ধ্বংস করতে না পারলে এবার ভয়ংকর রূপ নেবে ডেঙ্গি। এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ‘প্রাক মৌসুম এডিস সার্ভে-২০২২’ শীর্ষক জরিপে রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড এবার ডেঙ্গির উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।
রাজধানীর দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডের ১১০টি স্থানে ডেঙ্গির প্রকৃত অবস্থা নিয়ে মাঠপর্যায়ে সমীক্ষা চালিয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। জরিপে উত্তর সিটির ৬৩টি এবং দক্ষিণ সিটির ৯৬টি বাড়িতে এডিস মশা অতিরিক্ত মাত্রায় চিহ্নিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে প্লাস্টিক ড্রামে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, সেখানে ২০২২ সালে মৌসুম পূর্ব জরিপে লার্ভার পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন। ২০২০ সালে ১২ জন মারা যায়।
২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে শুধু আগষ্ট মাসেই মারা যায় ৩০ জন। বেসরকারি হিসাবে ২০২১ সালে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সাবেক নবজাতক ইউনিট প্রধান ও বারডেম হাসপাতালের (শিশু-২) শিশু বিভাগ প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, বৃষ্টির এ সময় কারও জ্বর হলে ডেঙ্গির সম্ভাবনাটা মাথায় রেখেই চিকিৎসা করাতে হবে। রক্তসহ যা যা দরকার, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গি যদি একবারের বেশি কারও হয়, তাহলে জ্বরের তীব্রতার সঙ্গে সার্বিক জটিলতা ভয়াবহ আকারে হতে পারে।
তিনি জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত যে কোনো বয়সি ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ঝুঁকি থাকে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গির ওষুধ নেই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি মাত্র। ডেঙ্গির জীবাণু তার মতো করেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে হানা দেয়। ডেঙ্গি যদি জটিল হয়, তাহলে এর চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় লাখ লাখ টাকা খরচ করার পরও আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন অনিশ্চত থাকে। শঙ্কা, সন্দেহ, উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়েই পুরো চিকিৎসাটা চলে। চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। দেশে চিকিৎসাসামগ্রী অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সচেতনা বৃদ্ধি, প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
একই সঙ্গে গণমাধ্যমে ডেঙ্গি প্রতিরোধ ও সচেতনতার বিষয়ে বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। মশারি ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে এখন থেকেই। দরজা, জানালায় অস্থায়ী নেট লাগানোও জরুরি।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, এবার দ্রুত সময়ের মধ্যে ডেঙ্গির বিস্তার ধ্বংস করতে না পারলে ভয়ংকর রূপ নেবে।
এডিস ধ্বংস করতে না পারলে আক্রান্তের সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার অধীনে ডেঙ্গির বাহক এডিস মশার ঘনত্বের প্রাক মৌসুম জরিপ-২০২২ এর প্রধান ছিলাম। এতে দেখা যায়, জমা পানিতে মশার লার্ভা জন্মানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বহুগুণ বেশি। ফলে ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্ত উদ্বেগ বাড়াচ্ছে নগর প্রশাসনের।
ড. কবিরুল বাশার জানান, ২০১৪ সাল থেকে তিনি ডেঙ্গি প্রতিরোধ, প্রজনন ধ্বংস, বিস্তার রোধ নিয়ে গবেষণা করছেন। জরিপে উঠে আসে, ২০২০ ও ২১-এর চেয়ে ২০২২-এ বৃষ্টিপূর্ব এডিসের ঘনত্ব বহুগুণ বেশি। এ জরিপ সিটি করপোরেশনে দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে এডিস মশার ঘনত্ব দিয়ে ডেঙ্গির প্রকৃত রূপ নিশ্চিত করা যায় না। অর্থাৎ ৯৫ শতাংশই নিশ্চিত করা যায় না। আমরা এটি করছি আগাম সতর্ক করার জন্য। সংশ্লিষ্টরা ও সাধারণ মানুষ সতর্ক না হলে ডেঙ্গি বাড়ে। প্রাণ কাড়ে। এডিসের সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ে ডেঙ্গি, যা রোধ করা সম্ভব হয় না। এডিস ধ্বংস করতেই হবে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে।