ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের জবাবে ইউরোপীয় দেশগুলো ইতোমধ্যে দফায় দফায় মস্কোর ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। যার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে ইউক্রেন অভিযান থেকে বিরত রাখা। পাশাপাশি এসব নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্যকে হ্রাস করা।
পশ্চিমাদের এত চেষ্টার পর বিন্দুমাত্র টলেননি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। উল্টো ইউক্রেনে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে ইইউ। ষষ্ঠ দফায় এ অবরোধের প্রধান উদ্দেশ্য রাশিয়ার তেল রফতানিকে ব্যাহত করা। পাশাপাশি রাশিয়ার আর্থিক খাতকেও লক্ষ্য করা হয়েছে।
তবে মজার ব্যাপার হলো রাশিয়ার গ্যাস খাতকে এ অবরোধ পরিকল্পনা থেকে বাদ রাখা হয়েছে।
বুধবার (৪ মে) ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভ্যান ডার লিয়েন এ অবরোধ আরোপের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
নিষেধাজ্ঞার সর্বশেষ দফার এ প্যাকেজে রাশিয়ার তেল রফতানির ওপর পূর্ণ অবরোধের পাশাপাশি দেশটির শীর্ষ ব্যাংক ছেবার ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচার ইউরোপে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও রাখা হয়েছে।
নতুন নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ছয় মাসের মধ্যে রাশিয়ার তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন উরসুলা ভন ডার লিয়েন।
তবে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর ব্যাপকমাত্রায় নির্ভরশীল ইইউসহ ইউরোপীয় দেশগুলো। রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর অবরোধ দিলে তাদের নিজেদের অর্থনীতি সচল রাখতে খুব শিগগিরই বিকল্প উৎস থেকে তেল ও গ্যাসের সন্ধান করতে হবে।
এদিকে রাশিয়ার ওপর নতুন এ অবরোধের পরিকল্পনার খবরে অস্থির হয়ে পড়েছে বিশ্বের তেলের বাজার। আগের দিনের তুলনায় আজ তেলের দাম ৩ শতাংশ বেড়ে অপরিশোধিত ব্রেন্ট ক্রুড ১০৯ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হলো ইইউর এ নতুন অবরোধ প্রস্তাবে রাশিয়ার তেল খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা থাকলেও গ্যাস রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সামিল থাকছে না। কারণ ইউরোপের দেশগুলো ব্যাপকমাত্রায় রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।
রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিলে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে পুরো ইউরোপে। এর জেরে ইউরোপের অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে বলে ইতোমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণা ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ডের ৬৭ শতাংশ, এস্তোনিয়ার ৪৬, লাটভিয়ার ১০০, লিথুনিয়ার ৪১, পোল্যান্ডের ৫৪, চেক রিপাবলিকের ১০০, স্লোভাকিয়ার ৮৫, হাঙ্গেরির ৯৫, রোমানিয়ার ৪৪, জার্মানির ৬৬, বুলগেরিয়ার ৭৫, ইতালির ৪৩, গ্রিসের ৩৮ শতাংশ ও নেদারল্যান্ডসের ২৬ শতাংশ গ্যাস আমদানি রাশিয়া থেকে হয়ে থাকে।
সব মিলিয়ে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহের ৪০ শতাংশ রাশিয়ার ওপর নির্ভর করে। ফলে এ মুহূর্তে গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা আঁচ করতে পেরেই মূলত আপাতত রাশিয়ার গ্যাস খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা মুখে আনছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
পাশাপাশি রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর অবরোধ নিয়ে বিভক্তি দেখা গেছে খোদ ইইউর মধ্যেই। ইতোমধ্যেই ইইউ সদস্য রাষ্ট্র স্লোভাকিয়া এবং হাঙ্গেরি জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকে সমর্থন করবে না।
তাদের অর্থনীতি ব্যাপক মাত্রায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল উল্লেখ করে উভয় রাষ্ট্র জানায়, আপাতত তাদের হাতে এর কোনো বিকল্প নেই।
মঙ্গলবার (৩ মে) স্লোভাকিয়ার অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী রিচার্ড সুলিক জানান, তাদের দেশের একমাত্র তেল পরিশোধন কোম্পানি স্লোভনাফট আপাতত রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ব্যবহার বন্ধ করতে পারবে না। কারণ এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন করতে তাদের কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
এমনকি ইইউ রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ওপর অবরোধ আরোপ করলেও তারা এ নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি চাইবেন বলে জানান তিনি।
অপরদিকে হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিতার সিজারতো জানান, রাশিয়া থেকে তাদের দেশে তেল ও গ্যাস পরিবহন বন্ধ করবে, এমন যে কোনো অবরোধের বিরুদ্ধে দেশটি ভোট দেবে।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস ছাড়া হাঙ্গেরির অর্থনীতি পরিচালনা করা কার্যত অসম্ভব।
তেলের পাশাপাশি রাশিয়ার আর্থিক খাতের ওপর আঘাত হানাও এবারের অবরোধের উদ্দেশ্য। রাশিয়ার শীর্ষ ব্যাংক ছেবার ব্যাংকসহ আরও দুটি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এগুলোকে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্লাটফর্ম সুইফট থেকে নিষিদ্ধ করা হবে। এ ছাড়া রাশিয়ার শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি তাদের ওপর ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও অবরোধে থাকবে।
তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ প্রস্তাব পাস হতে সংস্থার ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের অনুমোদন লাগবে। ইইউ সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়ার তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও হাঙ্গেরি কিংবা স্লোভাকিয়াকে সাময়িক সময়ের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে কারণ তাদের অর্থনীতি রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।