আদালতে শুনানি চলাকালে একজন নিরপরাধ নাগরিকের একটা লোহার খাঁচার ভেতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টি অত্যন্ত অপমানজনক ও গর্হিত কাজ বলে মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার (১২ জুন) তার বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার শুনানির পর অভিযোগ গঠন শেষে আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
এদিকে আদালত সূত্রে জানা গেছে, বিচারক তাকে এজলাসের সামনের চেয়ারে বসতে বলেছিলেন। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই উদ্যোগী হয়ে, অন্য আসামির সঙ্গে গিয়ে দাঁড়ান লোহার খাঁচা সদৃশ কাঠগড়ায়। পরে আদালত থেকে বের হয়ে লোহার খাঁচা নিয়ে জানান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।
ড. ইউনূস বলেন, আদালতে শুনানি চলাকালে একজন নিরপরাধ নাগরিক একটি লোহার খাঁচার (কাঠগড়া) ভেতর গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টি অত্যন্ত অপমানজনক। অনেক হয়রানির মধ্যে আছি, এটি আপনারা (সাংবাদিক) বুঝতে পারছেন। কাজেই সেটারই অংশ এটা চলতে থাকবে। আজকে সারাক্ষণ আমরা সবাই মিলে খাঁচার মধ্যে ছিলাম। যদিও আমাকে বলা হয়েছিল আপনি থাকেন, আমি বললাম যাই, সবাই যাচ্ছিল তাই আমিও গেলাম। সারাক্ষণই খাঁচার মধ্যে ছিলাম। আমি আবারও প্রশ্ন তুলছি, এটা কী ন্যায্য হলো না কি। আমার বিষয় নয়। যে কোনো আসামি তার বিরুদ্ধে মামলা হতে যাচ্ছে, আমি যতদূর জানি ওই আসামি যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধী প্রমাণিত না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নির্দোষ, নিরপরাধ।
তিনি আবারও বলেন, আদালতে শুনানি চলাকালে একজন নিরপরাধ নাগরিকের একটা লোহার খাঁচার ভেতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টি অত্যন্ত অপমানজনক ও গর্হিত কাজ। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, সেটা বিষয় না। এটা কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এ বিষয়টি নিয়ে আপনারা একটু আওয়াজ তুলুন, এটা নিয়ে পর্যালোচনা হোক। একটা সভ্য দেশে কেন এমন হতে যাবে? কেন একজন নাগরিককে পশুর মতো খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, শুনানির সময়। যেখানে বিচার শুরুই হয়নি। যেখানে সে অপরাধী সাব্যস্তই হয়নি। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে কেন খাঁচার মধ্যে থাকতে হবে। প্রশ্নটা তুললাম, যারা বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত আছেন, যারা আইনজ্ঞ আছেন; তারা পর্যালোচনা করে দেখুন, এটা রাখার প্রয়োজন আছে, না নেই। সারা বিশ্বে যেভাবে সভ্য দেশে হয় বিচার কাজ, আমরাও না হয় সভ্য দেশের তালিকাতে গেলাম।
ড. ইউনূস সাংবাদিকদের আরও বলেন, আমাকে বলা হচ্ছে মানিলন্ডারিং, অর্থ আত্মসাত, প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। এ শব্দগুলোর সঙ্গে আমার কী যুক্ত আছে, আমি জানি না। এটা আমি শিখি নাই কোনো দিন, করিনি কোনোদিন। প্রচণ্ড রকম শব্দগুলো আমার ওপর আরোপ করা হচ্ছে, সেটার বিচার করা হবে। এটা বুঝতে পারছি না। এটাই হয়রানি। একটা হলো আমি তো রক্তচোষা, আমি তো সুদখোর, একটা হলো আমি দেশের শত্রু, পদ্মা সেতুর অর্থ আটকে দিয়েছি। আমি তো চারিদিকে ষড়যন্ত্র করেই বেড়াই। এগুলো তো হয়রানি, কথার কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে তারা।
ড. ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সরকারপক্ষ বারবার চেষ্টা করছে, মামলাটাকে অতিদ্রুত সমাপ্তি করার জন্য। আমরা বলেছি, এটা তো দ্রুত বিচার ট্র্যাইবুনাল না। তারপর ১৫ জুলাই পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
তিনি আরও বলেন, নিয়মিত হয়রানি করা হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে, আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব আমরা।
এদিকে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ১৫ জুলাই পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন এ আদেশ দেন।
এর আগে ২ জুন ড. ইউনূসসহ ১৪ আসামির অব্যাহতি চেয়ে করা আবেদন এবং অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশের জন্য এদিন ধার্য ছিল। গত ২ মে দুদকের মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনকে জামিন দেন আদালত। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য ২ জুন দিন ধার্য করা হয়। গত বছরের ৩০ মে দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
এ মামলার আসামিরা হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও পরিচালক এস. এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ। এছাড়াও গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান ও প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম।
এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসামিরা গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কল্যাল তহবিল থেকে ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।