আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ আসনেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে ভোটগ্রহণের দাবি জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আবশ্যকীয় সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তত্ত্বাবধানে ন্যস্তসহ ১৪টি প্রস্তাব করেছে দলটি। একইসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ‘অতীত ও বন্ধ অধ্যায়’ আখ্যায়িত করে এ বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার সাংবিধানিকভাবে কোনো কর্তৃপক্ষের নেই বলেও জানিয়েছে দলটি। এই বিষয়ে সাংঘর্ষিক কোনো মন্তব্য করা সংবিধান লংঘন করার শামিল বলেও উল্লেখ করেছে।
রোববার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে এসব কথা উল্লেখ করা হয়। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল আওয়ামী লীগকে জানান, সংলাপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ দল ইভিএম বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলটির ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল ইসির সঙ্গে সংলাপ করেন। সংলাপে সিইসি ও চার কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে আওয়ামী লীগের লিখিত বক্তব্য পড়েন দলের সাধারণ সম্পাদক। এতে নির্বাচন আয়োজনে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে সহযোগিতা চান সিইসি ও চার কমিশনার। এ সময় সিইসি সংলাপে উঠে আসা প্রস্তাবের সারসংক্ষেপও তুলে ধরেন।
সিইসি বলেন, আজকে এটা শেষ সংলাপ। এই সংলাপের একটি দ্বিমাত্রিকতা আছে। আমরা সরকারের সঙ্গেও সংলাপ করছি। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও সংলাপ করছি। এদিক থেকে আমরা সৌভাগ্যবান যে সরকারকেও অ্যাড্রেস করতে পারছি। পার্টি হিসেকে আওয়ামী লীগকেও অ্যাড্রেস করতে পারছি। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে যে সংলাপ করে এসেছি সেখানে কিছু বিষয় উঠে এসেছে। যেহেতু আপনারা সরকারে আছেন কাজেই সেটা আপনাদের দৃষ্টিতে আনা উচিত।
ইভিএম প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ইভিএম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশকিছু সমর্থন পেয়েছি। আবার অধিকাংশ দল ইভিএম বিশ্বাস করছে না। এর ভেতরে কি যেন একটা আছে। আমাদের ইভিএম নিয়ে যে অনুভূতি- আমরা ইভিএম ব্যবহার করেছি। আমরা এটাকে ডিসকারেজ করছি না। আমরা এখন পর্যন্ত যে ইভিএম ব্যবহার করেছি তাতে ভোটার ৭১% পর্যন্ত টার্নআউট হয়েছে। কিন্তু অনেককে আমরা আস্থায় আনতে পারছি না। কথাও বলেছি- কিন্তু তারা বলেছে ‘না’ এখানে একটা..। আপনাদের এ বিষয়ে সহযোগিতা চাইব যে, ইভিএম নিয়ে একটা সংকট থাকবে। এটার বিষয়ে আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরাই নেব সিদ্ধান্ত। কিন্তু আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি, এর ওপর পুরোপুরি ঐক্যমত্য নেই।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা কমিশনের সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ দায়িত্ব। একইভাবে সরকারের কমিশনকে সহায়তা করা সরকারের সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ দায়িত্ব। আমরা সে দায়বদ্ধতা থেকেই সংলাপের আয়োজন করেছি। ১৯৭০ থেকে আমরা নির্বাচন দেখে এসেছি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন আমরা জানি। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন এক অর্থে সাম্প্রতিক। রাষ্ট্রপতি শাসিত নির্বাচন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতিতে ১৯৯১ সাল থেকে সম্ভবত নির্বাচন হচ্ছে। অতীতের অনেক নির্বাচন নিয়েই সমালোচনা বা তর্ক-বিতর্ক হলেও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অতিমাত্রায় সমালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনাও তীব্র ও তিক্ত। নিরপক্ষ থেকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে সমালোচনা ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে চাই।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমরা প্রায় চার-পাঁচ পর্বে সুধীজনদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করেছিলাম। সুধীজন তাদের মতামত উপস্থাপন করেন। নির্বাচনে অর্থশক্তি, পেশিশক্তির প্রভাব, নির্বাচনে সহিংসতা, ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই করে বাক্স ভরাট করা, ভোটকেন্দ্রে বাধা প্রদান, আমলাতন্ত্রের পক্ষপাতিত্ব, আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের ভূমিকা, নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা, সরকারের পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি বিষয়ে মতামত ওঠে এসেছে। আমরা মতামতকে পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে অবহিত করেছি।
তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করতে চেষ্টা আন্তরিকভাবে করে যাব। এই সংলাপ বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। আওয়ামী লীগ সম্ভবত দেশের প্রাচীনতম এবং সাংগঠনিকভাবে সুসংগঠিত একটি রাজনৈতিক দল। বড় দলের কাছে প্রত্যাশাও বেশি থাকে। পরপর তিনবার সরকারে অধিষ্ঠিত। এইজন্য সাধারণ জনগণ আওয়ামী লীগকে সরকারি দল বা ক্ষমতাসীন দল বলে থাকে। কিন্তু সংবিধানে সরকারি দল বা ক্ষমতাসীন দল বলে কোনো কথা নেই। আমি যদি ভুল বুঝে না থাকি, আওয়ামী লীগ আর দশটি দলের মতোই একটি রাজনৈতিক দল। সরকার একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্রীয় সংগঠন। এটি অবস্থানের একটি দ্বিমাত্রীকতা। কমিশনের ইচ্ছা, সদিচ্ছা এবং অনুভূতি; সরকার এবং আপনার দলের সবাইকে অবহিত করে বাধিত করবেন।
সিইসির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপে যারা যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তারা প্রত্যেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র্যাব সবই কিন্তু নির্বাচনে থাকে। যখন যাকে প্রয়োজন হয়, তখন তাকে কাজে লাগায়। তিনি বলেন, ‘যারা যারা নির্বাচনে আসতে চাচ্ছে না সেটা কিন্তু তাদের চিরতরের অভ্যাস। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাদের (বিএনপি) আহ্বানে জাতিসংঘ বাংলাদেশে এসেছিল। জাতিসংঘ তাদের সঙ্গে এবং আমাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা বসেছিল। এরপর আমাদের দুই দলকে নিয়ে বসেছিল। কিন্তু তারা কোনো যুক্তি খণ্ডাতে পারেনি। আমরা সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচনটা করতে হবে, সেটা জাতিসংঘসহ বিএনপিকে বলেছিলাম। আমরা এও বলেছিলাম যে, আপনারা যদি নির্বাচনে আসেন, তাহলে ছয়মাস পরে আমরা আরেকটা নির্বাচন করব। তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় এখন নির্বাচনটা করতে হবে। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটা করা হোক।’
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আমীর হোসেন আমু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে। কিন্তু হাইকোর্টের আদেশে সেটা আর রাখা সম্ভব হয়নি। অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সবসময়ই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। ইভিএমে কিন্তু বিভিন্ন নির্বাচন করা হচ্ছে। ইভিএমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এটা আমার জানা নাই। এখন তারা ইভিএমের ত্রুটি কীভাবে প্রমাণ করবে। এতগুলো নির্বাচন হলো এবং নির্বাচনে তাদের কোনো অভিযোগও নাই। তারাও কিন্তু ইভিএমের নির্বাচনে সব জায়গায় অংশগ্রহণ করছে। সুতরাং এই কথাগুলো বলে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে বিএনপি। ইসি যেভাবে নির্বাচন করবে আমরা সেভাবে সহযোগিতা করব বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে ছিলেন সভাপতিমলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফর উল্লাহ, ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক বেগম শামসুন নাহার।