অক্টোবর ২৫, ২০২৪ ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ
রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের থাকা না থাকা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনা চলছে। দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বৃহস্পতিবার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়াও সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩২ নির্ধারণ এবং সরকারি খরচে এ বছর কাউকে হজে না পাঠানোরও বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিন রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এসব তথ্য জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন-প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করবে, আর সরকার বসে বসে দেখবে, তা হতে পারে না। এছাড়া পুলিশের কোনো কোনো সদস্যদের এখনও নির্লিপ্ততা রয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে-এই বৈঠকে বহুল আলোচিত রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয় ব্যাপক গুরুত্ব পায়। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতের ভিন্নতা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ।
অন্যদিকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে এবং সেটা তারা চায় না। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের আশঙ্কা সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে তৃতীয় কেউ সুযোগ নিতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই এ ব্যাপারে সমাধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ব্রিফিংয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে, সেটি আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। একইসঙ্গে কিছু রাজনৈতিক দল সাংবিধানিক সংকটের কথা বলছে, সেটিও আমরা বিবেচনায় নিয়েছি।
আবার ওই দলেরই দু-একজন সিনিয়র নেতা বলছেন, সাংবিধানিক সংকট হবে না। সবকিছু মিলে রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে পরিষ্কারভাবে আসেনি। ফলে বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। এতটুকু বলতে পারি, রাষ্ট্রপতি প্রশ্নে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, যেহেতু পদত্যাগের একটা দাবি আছে। দাবিটা ক্রমান্বয়ে জোরালো হচ্ছে। এটি এক ধরনের গণদাবি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকেই এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান এবং সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি রাজনৈতিক আলোচনা। এটাকে আইনি কিংবা সাংবিধানিক বাধা হিসাবে দেখছি না। কারণ আমরা বর্তমানে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নেই। ফলে সবকিছু সংবিধান মেনে করতে হবে, সেটা সম্ভব হবে কিনা তা আমাদেরকে ভাবতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই ইস্যুকে আমরা রাজনৈতিক বিষয় হিসাবেই দেখছি। তবে এই সিদ্ধান্ত নিতে কতদিন সময় লাগবে, তা এ রকম করে বলা যায় না। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে। তারা কী ভাবছে, তাদের আশঙ্কার জায়গা কোথায়। আবার সেসব আশঙ্কা আদৌ বাস্তবসম্মত কিনা। এতটুকু বলতে পারি, এই সিদ্ধান্ত নিতে আমরা যে তাড়াহুড়া করছি, তা নয়। আবার বিলম্বিত করাও যাচ্ছে না। কারণ এটা এমন একটা পদ, যেখানে দীর্ঘদিন অনিশ্চয়তার ভেতরে কেউ থাকতে চাইবে না। বিশেষ করে যেখানে গণদাবি উঠেছে, সেটাকে বিলম্বিত করার হয়তো সুযোগ নেই। তবে কতদিন এটা বলা যাচ্ছে না।
এদিকে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনার মধ্যে বুধবার দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের তিন নেতা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তাদের অবস্থান জানিয়েছেন। দলটি এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায় না। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্রপতি পদে শূন্যতা হলে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে। গত কয়েক দিনে মো. সাহাবুদ্দিনকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে নতুন মুখ খুঁজতে সরকারের তরফ থেকে নানামুখী তৎপরতার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
প্রসঙ্গত সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের লিখিত কপি তিনি পাননি। তবে তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে বিদেশে পালিয়েছেন। এর পরই বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে গত সোমবার আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করছেন। তার নতুন বক্তব্য স্ববিরোধী এবং এতে তার শপথ লঙ্ঘন হয়। ফলে এই পদে থাকার তার যোগ্যতা আছে কিনা, সে সম্পর্কে প্রশ্ন আসে। কারণ, তিনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন।
পরের দিন মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে আসিফ নজরুল যে বক্তব্য দিয়েছেন, সরকার তার সঙ্গে একমত। এরপর বিভিন্ন মহল থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি তুলে মঙ্গলবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করেন। ওইদিন রাতে তারা বঙ্গভবনের সামনেও বিক্ষোভ করেন।
ব্রিফিংয়ে রিজওয়ানা হাসান আরও জানান, এ বছর সরকারি খরচে কেউ হজে যাবেন না। শুধু হজ ব্যবস্থাপনার জন্য যাদের যেতে হয়, তারা যাবেন। এছাড়াও হজের ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যতটা সম্ভব ব্যয় কমানো হবে। এই মাসেই হজের প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে। তবে ব্যয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের পাশাপাশি সৌদি আরবের ব্যবস্থাপনা জড়িত। ফলে এবার কত ব্যয় তা জানার জন্য ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে সৌদি সরকার বলেছে, আমরা যদি নৌপথে হাজিদের পাঠাতে পারি, তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এ বিষয়ে হাজিদের আগ্রহের বিষয় সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
সৈয়দা রেজোয়ানা হাসান বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরেকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটা হলো-হজ ব্যবস্থাপনার জন্য যাদের যেতে হয় তারা ব্যতীত এ বছর সরকারি অর্থে কেউ হজে যাবেন না। হজের ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যতটা সম্ভব হজযাত্রীদের ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হবে। হজের প্যাকেজ হয়তো এই মাসের শেষেই ঘোষিত হবে। তখন দেখতে পাবেন যে, আমরা কতটা কমিয়েছি। এটার সঙ্গে আমাদের ব্যবস্থাপনা, সৌদির ব্যবস্থাপনা-সবকিছু মিলেই যেহেতু করতে হয় সেহেতু ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকারকে যেহেতু ক্ষমতা দেওয়া আছে যে, একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বসে বসে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যেখানে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট আমাদের কাছে এসেছে। তিনি জানান, অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো আলোচনাই আমাদের হয়নি। এদের (ছাত্রলীগ) বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, আগেও ছিল, এটা কন্টিনিউ। তাই সে কারণে আমরা এ (নিষিদ্ধ) সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ছাত্রলীগের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। তবে, একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের ক্ষেত্রে যেভাবে ড্রিল করা হয়, লিগ্যাল প্রসেসে সেভাবে হবে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ইস্যুতে বিদেশি সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক চাই। এটি দুই দেশের জন্য দরকার এবং দুপক্ষই আমরা এটি বুঝি। তবে ভিসা ইস্যুতে কঠোর নীতির কারণে বাংলাদেশের জনগণ অখুশি। তবে আমি মনে করি না এ অবস্থার (ভিসা) উন্নতির জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভারতের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনার অগ্রাধিকার ইস্যু নয়। কারণ ভিসা হচ্ছে ভারতের নিজস্ব বিষয়। আমাদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র এবং বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া অনেক লোক ভারতে আশ্রয় পেয়েছে।
সন্ত্রাসী সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বসে বসে দেখার কোনো সুযোগ নেই : ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, আপনারা গণমাধ্যমে হেলমেট বাহিনী, হকিস্টিক, পুলিশের কাপড় পরে ছাত্রলীগ হামলা করেছে-এরকম সবাই লিখেছেন। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, অনেক আগে থেকেই হামলা করছে। একেবারে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শুরু করে যেকটি ছাত্র আন্দোলন হয়েছে সবকটি আন্দোলনে ছাত্রলীগকে আমরা সন্ত্রাসী ভূমিকায় দেখেছি। এমনকি তখন যারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় ছিল, তাদের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ছাত্রদের শায়েস্তা করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা হয়েছে সন্ত্রাসী কায়দায় আন্দোলন দমনে। প্রমাণের জন্য কারও না জানার না বোঝার কারণ নেই।
তিনি বলেন, তাদের (ছাত্রলীগ) নিষিদ্ধের আরেকটি কারণ হচ্ছে যে, জুলাই গণহত্যার পরেও যে তারা থেমে গেছে তা কিন্তু নয়। আপনারা গণমাধ্যমে রিপোর্ট করেছেন শুধু তাই নয়; আদালত কর্তৃকও বেশ কয়েকবার তারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। আমরা কিন্তু আবরার ফাহাদের কথা ভুলে যেতে পারি না। আমরা বিশ্বজিতের কথা ভুলে যেতে পারি না। এগুলো আমাদের সবার চোখের সামনে ঘটেছে। আসিফ (উপদেষ্টা) আসলে বলতে পারতেন যে, ও কীভাবে ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত যেটা নেওয়া হয়েছে সেটা বর্তমানে প্রাধিকার বিবেচনায় আমাদের নিতে হয়েছে। কারণ, এখন যে বিভিন্ন সংস্থা আছে, তাদের যে রিপোর্ট আছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করতে, রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে, এমনকি ৫ আগস্টের পরেও যারা ওই সময় ছাত্র আন্দোলন করেছেন তাদের ওপর আক্রমণ করেছে ছাত্রলীগ।