ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল দলটি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিরোধী দলগুলোর আপত্তির মুখে এক তরফা ভোট করে পুনরায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ‘উন্মুক্ত ভোট’ কৌশলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হলেও শেষ পর্যন্ত সরকার টেকাতে পারেনি দলটি। একটি ছাত্র আন্দোলন ঘুরিয়ে দেয় ক্ষমতার মোড়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশজুড়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন এবং আন্দোলনে সমর্থন জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩৬ দিনের মাথায় পদত্যাগ করে দেশে ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে, সরকার পতনের মধ্য দিয়ে স্বস্তি ফিরেছে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোতে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর নেতারা। পট পরিবর্তন হচ্ছে দেশের সর্বত্র। সরকার পতনের তিন দিনের মধ্যে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীনকালীন সরকার। ত্রয়োদশ নির্বাচন ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোতেও সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছেন নেতারা।
গত সোমবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, সিপিবি ও বাসদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে কয়েকটি দলের সঙ্গে এখনো বৈঠক হয়নি বলে জানা গেছে। বৈঠকে দলগুলো তাদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। পোস্টে তিনি লেখেন, বাংলাদেশের জনগণ অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীনভাবে ভোটাধিকারের প্রত্যাশা করে, যেন তারা তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। তবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলেছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়ার পরদিনই অভিনন্দন জানায় জামায়াতে ইসলামী। অভিনন্দন বার্তায় দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার তাদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। তিনি দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
সরকারে কাছে ১০টি প্রত্যাশার কথা জানায় এবি পার্টি। দলের সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এবি পার্টি এরই মধ্যে ১০টি প্রত্যাশার কথা প্রধান উপদেষ্টার কাছে লিখিত আকারে জানিয়েছে।
এবি পার্টির পত্যাশাগুলো হলো- ১. দেশ গঠনের মহা চ্যালেঞ্জ এখন ছাত্র-জনতার কাঁধে। এ চ্যালেঞ্জে সফল হতেই হবে। ধৈর্য, সহনশীলতা, ত্যাগ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার সুরক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে আসুন একযোগে কাজ করি। ২. ছাত্র-জনতার অসীম আত্মত্যাগ ও রক্তদানে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে। তা না পারলে শহিদেরা আমাদের ক্ষমা করবে না। ব্যর্থতার জন্য অদূর ভবিষ্যতে আমাদের পরিণতিও হতে পারে আওয়ামী লীগের অনুরূপ। ৩. ভারতীয় বিশেষ কিছু গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক পক্ষ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা বন্ধ করুন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টির অপচেষ্টা বন্ধুত্বের লক্ষণ নয়। ৪. মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টানসহ সকল ধর্মের আমরা সবাই বাংলাদেশি-বাঙালি। কেউ সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু নই। এখানে কোনো বৈষম্য বা পৃথক স্বত্ত্বাগত বিভাজনের সুযোগ নেই। জীবন দিয়ে হলেও আমাদের সবাইকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন রক্ষা করতে হবে। ৫. শেখ হাসিনা ও তার দোসররেরা অবৈধ ক্ষমতার গদি টিকিয়ে রাখতে গিয়ে যে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নৃশংসতা চালিয়েছে অবিলম্বে তার সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি ব্যক্তি ও পরিবারের ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। ৬. গণঅভ্যুত্থানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পুরো দায় শেখ হাসিনা ও তার আগ্রাসী খুনি-দোসরদের। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর যে কোনো প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ডের দায় বর্তমান সরকার ও আন্দোলনকারী সকল পক্ষের। অবিলম্বে সরকার ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত সমন্বিত পদক্ষেপে সর্বাত্মক জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ৭. পদস্থ যে কোনো কাউকে অপসারণ বা তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মূলনীতি হতে হবে তার দ্বারা কৃত অপরাধ ও অন্যায্য, অন্যায়মূলক ভূমিকা। পক্ষান্তরে নতুন যে কোনো নিয়োগ বা পদায়নের ভিত্তি হতে হবে মেধা, দক্ষতা, সততা, পূর্ববর্তী অবৈধ সরকার দ্বারা বঞ্চিত ও অবহেলিত হওয়া এবং বিগত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তার অবদান ও ভূমিকা। ৮. অন্তবর্তীকালীন সরকারের সামনে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। ভঙ্গুর ও বিধ্বস্থ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের অঙ্গীকার এবং যতদ্রুত সম্ভব সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যৌক্তিক কারণ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ প্রলম্বিত হলে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবার ঝুঁকি তৈরি হয়। আশা করি সেদিকে সবাই সচেতন থাকবেন। ৯. গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষায় নিয়োজিত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল পক্ষ এবং উন্নয়ণ সহযোগীদের প্রতি আহ্বান বাংলাদেশের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানকে সফল করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিন। ১০. দ্রব্যমূল্য কমিয়ে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা, সকল পর্যায়ের কল-কারখানা সচল রাখা, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চালনসহ দেশের অর্থনীতিতে নতুন করে সংস্কার ও উদ্যম ফিরিয়ে আনতে সকলের সমন্বিত প্রয়াস জোরদার করতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। যদিও তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেননি। তবুও তাদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে দলটির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছি। তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, তারা দেশে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনবে। দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনবে। যতদিন পর্যন্ত দেশের অমূল পরিবর্তন হবে না ততদিন পর্যন্ত তারা দায়িত্বে থাকুক। আমরা একটা অর্থবহ পরিবর্তন চাই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার শেষে এই সরকার সুস্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করবে বলে আশা করি। বর্তমানে দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির হাইকমান্ডের এক নেতা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়েছে। এটাই আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে দেশের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছে। তিন মাসের মধ্যেই দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে জনকল্যাণমুখী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়, তাই আমরা এই সরকারকে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদে সময় দিতে চাই। যৌক্তিক মেয়াদে সময় দিতে চাই। যে সময়ের মধ্যে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে।
তিনি আরো বলেন, পুলিশ বাহিনী, বিচারালয়েও ব্যাপক রদবদল শুরু হয়েছে। খুব দ্রুতই দেশের সার্বিক বিষয়কে পূর্ণ গঠন করে গণতান্ত্রিক সরকার উপহার দেওয়ার জন্য সুন্দর নির্বাচন দিয়ে তারা তাদের জায়গায় ফিরে যাবে। জনসাধারণের সরকার আগামীতে দেশ পরিচালনা করবে। এটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।