সোহেল রায়হান, স্টাফ রিপোর্টার
ইয়াবা এমনি একটি মাদক যা মানুষকে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেয়না বরং মৃত্যুর আগে এটি পাগলে পরিনত করে। থাই ভাষায় ইয়াবা শব্দটির অর্থ পাগলা ঔষধ বা পাগলের ঔষধ। অনেকে এটিকে বলে 3G মেডিসিন। ইয়াবা হলো মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের সংমিশ্রণ। এই মাদকটি একাধারে মস্তিষ্ক ও রিদযন্ত্রে আক্রমন করে। দীর্ঘ সময় ব্যাপি যুদ্ধ ক্ষেত্রে সেনাদের যাতে ক্লান্তি না লাগে কিংবা লঞ্চ ও বিমানের পাইলটদের নিদ্রাহীনতা, মনকে প্রফুল্ল ও চাঙ্গা রাখার জন্য এটা আবিষ্কার করা হয়। দীর্ঘ দিন ইয়াবা সেবনে শারিরীক ও মানষিক মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়। এর মরন ছোবলে জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে ইয়াবা এক মহামারী আকার ধারণ করেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্তদের মধ্যে অন্তত ৩০ লাখ ইয়াবায় আসক্ত। কথিত আছে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মান একনায়ক “এডলফ হিটলার” তার মেডিকেল চিফকে আদেশ দেন এমন একটি ঔষধ তৈরি করতে যেনো এটি খেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করলেও যুদ্ধ ক্ষেত্রে সেনাদের ক্লান্তি বা হতাশা না আসে। হিটলারের নির্দেশে জার্মানি কেমিস্টরা দীর্ঘ গবেষণার পর এটি তৈরি করতে সমর্থ হয়। তখন এর নাম ছিল “পারভিটিন”। পরবর্তীতে মিয়ানমারে এসে এটা ভিন্ন রুপ লাভ করে। জানা যায় যেসব ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে পাহাড়ে মালামাল ওঠানামা করা হয় সেসব গাড়ির ঘোড়া আর সহজে পাহাড়ে উঠতে চায়না আর সে কারনে ঘোড়াকে ক্ষেপিয়া তোলার জন্য থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমারের সান প্রদেশে বার্মিজরা এরকম ড্রাগ ঘোড়াকে খাওয়াতো। পরবর্তীতে প্রচন্ড কায়িক শ্রমে জড়িত মানুষ এবং থাইল্যান্ডের ট্রাক ড্রাইভারেরাও এই ঘোড়ার ট্যাবলেট খাওয়া শুরু করে। পর্যায়ক্রমে এটি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের যৌনকর্মীরা সেবন করা শুরু করে। বর্তমানে এই মরন নেশা বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাউসের সীমান্তবর্তী অঞ্চলকে বলা হয় মাদক উৎপাদনের আখড়া। সেখানে প্রচুর পরিমাণে পপি চাষ করা হয়। যুগ যুগ ধরে সেখানে হেরোইন উৎপাদিত হয়ে আসছে। আর হেরোইন উৎপাদন অনেক ঝামেলার কাজ কিন্তু রাসায়নিক উপাদান দিয়ে খুব সহজেই ইয়াবা তৈরি করা সম্ভব। যে কারনে গত শতাব্দীর শেষের দিকে এই অঞ্চলে মাদক ব্যবসায়িরা ইয়াবা উৎপাদন শুরু করে দেয় কারন ইয়াবা উৎপাদন যেমন সহজ তেমনি লাভজনকও বটে। ইয়াবা তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় ৪০% মেথাফেটামাইন ও ৬০% ক্যাফেইন। তরুন তরুনীদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদানের সাথে মেশানো হয় আঙ্গুর, কমলা ও ভ্যানিলার ফ্লেভার। ইয়াবা নামের এই ছোট্ট ট্যাবলেটটির ওজন সাধারণত ১.৫ মিলিগ্রাম,এটি দেখতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো স্বাদেও তেমনি। ফলে আসক্ত ব্যাক্তিরা এর প্রচন্ড ক্ষতিকর প্রভাব প্রথমে অনুধাবন করতে পারেনা। ইয়াবার সাইজ ছোট হওয়ার কারনে পরিবহন করা ও লুকিয়ে রাখাও খুব সহজ। ইয়াবায় আসক্ত ব্যক্তিরা সাময়িকভাবে জীবনের সব যন্ত্রণা ভুলে যায়, তারা বাস করে স্বপ্নের মতো এক জগতে। ইয়াবায় প্রচন্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে এটি যৌন উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে থাকে। এর পাশাপাশি এটি ক্ষুধা কমিয়ে দেয় বলে স্লিম হওয়ার ঔষধ হিসেবেও অনেকে সেবন বা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এই সাময়িক আনন্দের ট্যাবলেটটি যে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে তা টের পাওয়ার অবকাশ তাদের কাছে থাকেনা। প্রথমে কম ডোজে এই ট্যাবলেটটি কাজ করলেও ধীরে ধীরে এর ডোজ বাড়াতে হয়। বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে ১৯৯৭ সালে। ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ সিমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসতে শুরু করে। টেকনাফ বাংলাদেশের ইয়াবা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত। ৯০ দশকে যারা পরের জমিতে লবন চাষ কিংবা নদীতে জাল ফেলে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা আজ ইয়াবা ব্যবসা করে কোঁটিপতি।
ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম তুলনামূলক ভাবে বেশি হওয়ায় প্রথমদিকে প্রধানত উচ্চবিত্তদের মাঝে এটি বিস্তার লাভ করেছিলো। পরবর্তীতে এই নতুন নেশার আনন্দ নিতে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার উর্তি বয়সী তরুণ তরুণীরা এই ড্রাগ নেওয়া শুরু করে।
ইউকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় তিন ধরনের ইয়াবা পাওয়া যায়। এক শ্রেণির ইয়াবা ট্যাবলেট সবুজ বা গোলাপি রঙের হয়ে থাকে এবং এর ঘ্রাণ অনেকটা বিস্কিটের মতো। ২য় ধরনের ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম তুলনামূলক কম কিন্তু এটিও নেশা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ৩য় ধরনের ট্যাবলেটটি আরো সস্তা এবং নেশায় আসক্ত ব্যক্তিদের নিকট এটি ভ্যাজাল হিসেবে পরিচিত। ইয়াবা খেলে সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা হলেও এর ব্যাপক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এই মাদক দ্রব্য ধীরে ধীরে সেবনকারীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। পাশাপাশি অনিদ্রা, খিটখিটে ভাব,ক্ষুধা কমে যাওয়া এবং শারীরিক সঙ্গমের ইচ্ছে বেড়ে যাওয়া সহ নানাবিধ সমস্যার লক্ষ্মণ দেখা যায়। হুট করে রিদস্পন্দনের গতি, রক্তচাপ, শ্বাসপ্রশ্বাস এবং শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। অনেক সময় মস্তিষ্কের শুক্ষ রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করতে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে রক্তনালীগুলো ছিড়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সেবনের কিছু দিন পর থেকে ইয়াবা সেবীর হাত পায়ের কাপুনী বা খিচুনি সহ হ্যালোসিনেশন তৈরি হয় এবং পাগলামি ভাব দেখা যায়। দীর্ঘ দিন ধরে ইয়াবা ট্যাবলেট খেলে স্বরনশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারো কারো ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষ্মণ দেখা দিতে পারে।
ইয়াবার পার্শপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিশিষ্ট মনো চিকিৎসক এবং সাহিত্যিক ডাঃ মুহিত কামাল বলেন- নিয়মিত ইয়াবা সেবনে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, খিচুনি, মস্তিষ্ক বিকৃতি,রক্তচাপ বৃদ্ধি, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি বিকল,টিউমার ও ক্যান্সারের মতো নানাবিধ মরনব্যাধি রোগ হতে পারে। ইয়াবা প্রথম প্রথম যৌন উত্তেজনা বাড়ালেও ধীরে ধীরে এটা জীবন ও যৌবন নিঃশেষ করে দেয়। ইয়াবা এমনি এক ভয়ংকর মাদক যার প্রভাবে মানুষ চরম হিংস্র হয়ে খুন পর্যন্ত করতে পারে।
তাই মরন নেশা ইয়াবার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি করা অতিব জরুরি।
আসুন সাময়িক সুখ,স্বস্তির জন্য-
মরন নেশা ইয়াবাকে না বলি,
সুস্থ সুন্দর সমাজ ও জীবন গড়ি।