নভেম্বর ৩, ২০২৪ ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ
দেশে খাদ্যশস্য ঘাটতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমান মজুত দিয়ে সরকার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ গত বছর এই সময়ে সরকারি গুদামে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত ছিল, চলতি বছর একই সময়ে তার চেয়ে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন চাল-গম কম মজুত রয়েছে। বর্তমান মজুত দিয়ে সংকট মোকাবিলা দুরূহ হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সরকার গত শুক্রবার চালের আমদানির ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় হোক কিংবা আন্তর্জাতিক উৎসই হোক চাল-গম সংগ্রহ করে এখনই খাদ্যসশ্যের মজুত বাড়ানো জরুরি। অন্যথায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিগুলো চালিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। খবর সংশ্লিষ্টরা জানান।
জানতে চাইলে খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, খাদ্য সংকট হবে না। সরকার ইতোমধ্যে আমদানির ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করেছে। ইতোমধ্যে বেসরকারিভাবে ২ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৫০ হাজার করে পৃথক দুটি দরপত্রে এক লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং সর্বনিু দরদাতা পেয়ে গেছি। এখন আমদানির পালা। তিনি আরও বলেন, দেশে গমের কোনো সংকট হবে না।
এছাড়া আগামী ৬ নভেম্বর আমন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই সরকার ক্রয় পরিকল্পনা করবে। খাদ্য সংকট নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই।
জানতে চাইলে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, জরুরি ভিত্তিতে মজুত বাড়াতে হবে। মজুত না বাড়ালে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিগুলো চালাতে পারবে না। আমন ধান আসতে এখনো ৪৫ দিন সময় লাগবে। প্রতি বছরের এ সময়টা চালের সংকট থাকে কিন্তু তা ঘনীভূত হতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে চাল আমদানি করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি গুদামে চাল ৯ লাখ মেট্রিক টন এবং গম ৪ লাখ মেটিক টন অর্থাৎ ১৩ লাখ মেট্রিক টন মজুত রয়েছে। বিগত এক বছর আগে একই সময়ে মজুত ছিল প্রায় ১৭ লাখ মেট্রিক টন। প্রতি মাসে ওএমএস ও রেশনিংয়ে (বাহিনীগুলোর জন্য চাল ও আটা), খয়রাতি সাহায্য (জিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (কাবিখা), টিসিবির ট্রাক সেল ও ফেয়ার প্রাইস নিয়মিত সরবরাহে মাসে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন। সেই হিসাবে বিদ্যমান মজুত দিয়ে সরবরাহ বেশ কঠিন হবে।
আবার আমন চাল বাজারে আসতে আরও প্রায় দুই মাস অপক্ষো করতে হবে। সরকার পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে ইতোমধ্যে চাল আমদানির ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যে চাল আমদানির অনাগ্রহ লক্ষ্য করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, চালের ঘাটতির অন্যতম কারণ হচ্ছে টিসিবি। এই সংস্থাটিকে প্রতি বছর খাদ্য মন্ত্রণালয় ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল দিচ্ছে। গত বছর জুন থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু টিসিবিকে দেওয়ার পর যে ঘাটতি হবে তা সংকুলানের জন্য বাড়তি চাল কেনা হয়নি। ফলে চালের মজুত কম রয়েছে।
তাদের মতে, আরও কমপক্ষে চার মাস আগ থেকেই খাদ্যশস্যের মজুত নিয়ে চিন্তা গবেষণা করা জরুরি ছিল। যে সময়ে খাদ্য মজুত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা দরকার ছিল তখন ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ ৫ আগস্টের পর খাদ্য প্রশাসনে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সাবেক সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। একই সময়ে নিয়মিত অবসরে গেছেন মহাপরিচালক (ডিজি) এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। যারা খাদ্যশস্য খাদ্য পরিকল্পনা করতেন, এমন তিনজনকে একই সময়ে বিদায় করায় এক ধরনের পেনিক সৃষ্টি হয়েছে। কর্মরতদের মধ্যে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের অনেকে কর্মরতদের আগের সরকারের অতি ঘনিষ্ঠ হিসাবে গণ্য করছেন। ফলে তারা ভালোমন্দ কোনো কিছু না বলে চুপচাপ সময় পার করেছেন। এখনো অনেক ক্ষেত্রে তাই করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্য একটি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল বিষয়। খাদ্য সংকট সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। এ সত্য এবং বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। তারা আরও বলছেন, উপরের দিকে সবাইকে বিদায় না করে কমপক্ষে ডিজিকে এক বছর রাখা যেত। তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগও ছিল না। তিনি বঞ্চিত কর্মকর্তা। তিনি সিনিয়র হয়েও জুনিয়রের অধীনে ডিজিগিরি করেছেন। সদ্যবিদায়ি ডিজির খাদ্য নিয়ে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও ছিল।
বর্তমানে সচিব, ডিজি ও এডিজি সবই নবাগত। তারা বুঝবেন না এমন নয় বরং খাদ্য পরিস্থিতি বুঝে উঠতে তাদের একটু সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক। ততক্ষণে তো সংকট ঘনীভূত হতে পারে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জুলাইয়ের শুরুতে ভারত থেকে আসা পানিতে সৃষ্ট বন্যার কারণে ১১টি জেলায় ধানসহ সব ধরনের ফল-ফসল বিনষ্ট হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে-ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর এবং বক্সবাজার।
সেপ্টেম্বর মাসে আবার উত্তরাঞ্চলে বন্যায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে আমনের উৎপাদন কম হবে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করতে হলে সরকারকে ধান-চালের দাম বাড়াতে হবে। আমন ধান ও চালের মূল্য না বাড়ালে সরকারি অভ্যন্তরীণ উৎসে চাল পাবে না। বর্তমানে প্রতি কেজি সিদ্ধ বোরো চালের সরকারি মূল্য ৪৫ টাকা। আতপ বোরো চালের মূল্য ৪৪ টাকা। প্রতি কেজি গমের মূল্য ৩৪ টাকা। প্রতি কেজি বোরো ধানের মূল্য ৩০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, দেশের চালকল মালিকদের সঙ্গে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে মিটিং করা সময়ের দাবি। কারণ তারা সরকারের সঙ্গে চাল সরবরাহের চুক্তি করে নিয়মিত তা ভঙ্গ করছে। এবার যেন কোনো চালকল মালিক চাল সরবরাহের চুক্তি ভঙ্গ করতে না পারেন সে বিষয়টি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে সরকারের উচিত বিকল্প উৎসগুলোর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা, যাতে ব্যবসায়ীরা (চালকল মালিকরা) কোনো কারণে ওয়াদা খেলাপ করলেও তাৎক্ষণিক যেন বিকল্প উৎস থেকে খাদ্যশস্য পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করা জরুরি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বুধবার (৬ নভেম্বর) এফপিএমসির মিটিং হওয়ার তারিখ নির্র্ধারণ করা হয়েছে। ওই মিটিংয়ে ২ লাখ মেট্রিক টন ধান এবং ৬ লাখ মেট্রিক টন আমন চাল কেনার সরকারি পরিকল্পনা রয়েছে। আমন ধান ও চাল ক্রয়ে কিছুটা হলেও মূল্য বৃদ্ধি পাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।