আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন: পোশাক ও সবজি রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার

আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন: পোশাক ও সবজি রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার

জাতীয় স্লাইড

অক্টোবর ২৩, ২০২৪ ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং মাল্টিপল ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দুবাই ও কাতারে অর্থ পাচার করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের গ্রাহক এমআই ট্রেডিং। হুন্ডি ও হাওলার আশ্রয় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির রেমিট্যান্সের অর্থ দেশ দুটিতে রেখে দিয়েছে। একই ব্যাংকের গ্রাহক প্রতিষ্ঠান টোটাল কোয়ালিটি কোম্পানি শাক-সবজি রপ্তানির নামে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। এক্ষেত্রে রপ্তানি দেখিয়ে নিয়েছেন নগদ সহায়তা। পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের অর্থ দেশে ফেরায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অর্থ পাচার ও হুন্ডির চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উঠে এসেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদনে। হুন্ডি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি প্রতিবেদনটি এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে।

বিএফআইইউ প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের আমিন কোর্ট করপোরেট শাখার গ্রাহক এমআই ট্রেডিং আন্ডার ইনভয়েসিং এবং মাল্টিপল ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার করে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির চলতি হিসাব বিবরণী পর্যালোচনায় হুন্ডির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া যায়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমআই ট্রেডিং ৯টি সেলস কন্ট্রাক্টের আওতায় অ্যাডভান্স টিটির বিপরীতে সর্বমোট ৭৯টি ইএক্সপির মাধ্যমে ফিলিপাইন, দুবাই ও কাতারের মোট তিন লাখ ১১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করেছে। এসব পণ্যের মধ্যে ছিল টি-শার্ট, ট্যাঙ্ক টপ, প্যান্ট, ট্রাউজার। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি পণ্যগুলোর দাম দেখিয়েছে শূন্য দশমিক ১১ ডলার থেকে শূন্য দশমিক ৬৬ ডলার পর্যন্ত। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য পড়ে ১২ থেকে ৭২ টাকা। তৎকালীন বাজার মূল্যের চেয়ে এসব পণ্যের দাম কমপক্ষে ৫ গুণ কম দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এমআই টেড্রিং ১৫ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪৫ ডলারের পণ্যের দাম দেখিয়েছে মাত্র তিন লাখ ১১ হাজার ডলার। অর্থাৎ শুধুমাত্র পণ্যের দাম কম দেখিয়েই প্রতিষ্ঠানটি ১৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা পাচার করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানিতে কমার্শিয়াল ইনভয়েসে পণ্যের দামে ২-২.৫ গুণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক বলে উল্লেখ করে তদন্তকারী দল। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি একই তারিখে, একই গন্তব্যে, একই ধরনের পণ্য রপ্তানিতে একাধিক ইনভয়েস ইস্যু করে রপ্তানি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। এক্ষেত্রে একটি বৃহৎ রপ্তানি চালানকে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চালানে ভাগ করার বিষয়টিকে শুল্ক গোয়েন্দার নজরদারি এড়ানোর প্রচেষ্টা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

শুধু তাই নয়, এমআই ট্রেডিং আমদানির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের জালিয়াতি করেছে । এক্ষেত্রে আমদানি করা পণ্যের দাম কম দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করেছে। এতে দেশের প্রবাসী আয় বিদেশেই রেখে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করে এমআই ট্রেডিং। এরপর ১০ দিনের মাথায় অগ্রণী ব্যাংকের আমিন কোর্ট করপোরেট শাখায় এক লাখ টাকা জমা দিয়ে ব্যাংকটিতে একটি চলতি হিসাব (নং-০২০০০১৮২০২১৭৯) খোলে প্রতিষ্ঠানটি। তদন্ত পরিচালনা পর্যন্ত ওই শাখায় লেনদেন হয়েছে তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা।

হিসাবটির লেনদেন বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, এতে বিভিন্ন ব্যক্তি দেশের নানা অঞ্চল যেমন- আমিরহাট, কুলিয়ারচর, পদুয়ার বাজার থেকে নগদ অর্থ জমা করে। প্রায় সব অর্থই জমা হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে গুলশান শাখা ও বনানী শাখা থেকে নগদে উত্তোলন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অবৈধ হুন্ডি, হাওলা প্রভৃতি পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে দুবাই, কাতারে কর্মরত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্সের অর্থ রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসনের নাম করে প্রেরণ করা হয়ে থাকতে পারে বলে উল্লেখ করে তদন্তকারী দল।

লেনদেন ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায়, নগদ জমাকারীদের মধ্যে কেউ রুপার ব্যবসা, হার্ডওয়্যারের ব্যবসা অথবা কেউ মুদির দোকানে চাকরি করেন। এসব গ্রাহক তৈরি পোশাক আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়। অর্থাৎ এসব লেনদেন গ্রাহকের স্বাভাবিক ব্যবসায়িক লেনদেন নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। জমাকৃত অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে গ্রাহক ও বিভিন্ন ব্যক্তি নগদে উত্তোলন করে। এসব অর্থ নগদে উত্তোলনের বিষয়টি অর্থের গতিপথ আড়াল করার প্রয়াস হয়ে থাকতে পারে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংক ছাড়াও সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এমআই ট্রেডিং অস্বাভাবিক কম মূল্যে পণ্য রপ্তানি করেছে। এক্ষেত্রে, এমআই ট্রেডিং ১৬টি সেলস কন্ট্রাক্টের আওতায় অ্যাডভান্স টিটির বিপরীতে মোট ২৩২টি ইএক্সপির মাধ্যমে ফিলিপাইন, দুবাই ও কাতারের প্রতিষ্ঠানের কাছে টি-শার্ট, ট্যাঙ্ক টপ, প্যান্ট, ট্রাউজার রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানিতেও একই ধরনের অনিয়ম করে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি রপ্তানি করা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমও সন্দেহজনক বলে উল্লেখ করেছে পরিদর্শন দল।

অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংকের গ্রাহক টোটাল কোয়ালিটি কোম্পানি তাজা শাক-সবজি বিদেশে রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে। রপ্তানির সেলস কন্ট্রাক্টগুলোতে রপ্তানি পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ, ইউনিটপ্রতি মূল্য, মোট রপ্তানির পরিমাণসহ কোনো তথ্যই উল্লেখ করা হয়নি। এসব তথ্য উল্লেখ না করে শুধুমাত্র মোট রপ্তানি মূল্য সেলস কন্ট্রাক্টে উল্লেখ করা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। বৈদেশিক বাণিজ্যের স্বাভাবিক কার্যক্রমের সঙ্গে এগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ। এছাড়া এই রপ্তানির আওতায় প্রতিষ্ঠানটি সরকার থেকে নগদ সহায়তা সুবিধা গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে ১৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার কৃষিপণ্য রপ্তানির বিপরীতে প্রায় তিন কোটি টাকার নগদ সহায়তা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভুয়া রপ্তানি অতিমূল্যায়িত দেখিয়ে ব্যাংক ও গ্রাহকের যোগসাজশে সরকারি তহবিলের অর্থ তছরুপ করেছে টোটাল কোয়ালিটি কোম্পানি। এছাড়া গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, নগদ সহায়তার অর্থ জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো অর্থ উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটি। এটি অর্থের গতিপথ আড়াল করার প্রয়াস বলে উল্লেখ করে তদন্তকারী সংস্থা।

শুধু তাই নয়, টোটাল কোয়ালিটি কোম্পানি ২টি ইএক্সপির বিপরীতে ৬০ হাজার ৭০ মার্কিন ডলার মূল্যের কৃষিপণ্য রপ্তানি করা হলেও ওই অর্থ এখনো বাংলাদেশে ফেরায়নি। রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসিত না হওয়ার বিষয়টি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) মোতাবেক অর্থ পাচারের শামিল। এই অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যেই বিদেশে আটকে রাখা হয়েছে বলে মনে করে তদন্ত দল।

এছাড়া টোটাল কোয়ালিটি কোম্পানির গ্রিন রোড শাখায় পরিচালিত চলতি হিসাবে (নং-০২০০০১২৯৫২৫০৮) বড় অঙ্কের কয়েকটি ট্রান্সফারের মাধ্যমে জমা ও স্বল্প সময়ের মধ্যে পুরো অর্থ নগদে উত্তোলন করার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে ৬৩ লাখ টাকা ট্রান্সফারের মাধ্যমে জমা হয়, যা পরবর্তীতে মাজেদুল নামের এক ব্যক্তি অনলাইনে (প্রিন্সিপাল শাখা) নগদে উত্তোলন করেন। একইভাবে অন্য একটি লেনদেনে ৫০ লাখ টাকা ট্রান্সফারের মাধ্যমে জমা হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে টোটাল কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারীর হাসান জুনাইদ করিম অনলাইনে (প্রিন্সিপাল শাখা) ও একেএম আসাদ অনলাইনে (সাত মসজিদ রোড শাখা) থেকে নগদে উত্তোলন করেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি কর্তৃক অনলাইন নগদ উত্তোলনের বিষয়টি অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক ও অর্থের গতিপথ আড়াল করার প্রয়াস বলে উল্লেখ করে তদন্তকারী দল।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অগ্রণী ব্যাংক আমিন কোর্ট শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, এমআই ট্রেডিং ছোট কোম্পানি। দেশ থেকে কম দামে গেঞ্জি কিনে বিদেশে রপ্তানি করে। ইতোমধ্যে বিএফআইইউকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *