ইউক্রেনে মস্কোর বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর নতুন করে দৃশ্যপটে এসেছে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের বিষয়টি, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছিলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর ‘ভালো বন্ধু’ হতে চায় ভারত। তবে ভারত দুর্বল হতে চায় না বলেও এ সময় মন্তব্য করেন তিনি, যা মূলত রাশিয়ান সামরিক সরঞ্জামের ওপর দিল্লির দীর্ঘস্থায়ী নির্ভরতারই ইঙ্গিত ছিল বলে মনে করেন অনেকে।
রুশ অস্ত্রের ওপর ভারত কতটা নির্ভরশীল?
বিশ্বে অস্ত্রের অন্যতম বড় ক্রেতা ভারত। বহু বছর ধরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ছিল দেশটির। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শত্রুতা আর চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও মস্কো ও দিল্লির সম্পর্ক অটুট ছিল।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) তথ্য অনুসারে, ১৯৯২ সাল থেকে ভারতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সামরিক সরঞ্জাম এসেছে রাশিয়া থেকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দ্য স্টিমসন সেন্টার বলছে, ভারতে যুদ্ধবিমান, পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, ট্যাংক এবং মিসাইলের মতো প্রধান অস্ত্র ব্যবস্থার ৮৫ শতাংশই রাশিয়া থেকে আসা।
ভারত কি অস্ত্র সরবরাহে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে?
গত দশকে রাশিয়ান অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য দেশ থেকে আরও বেশি সরঞ্জাম কিনেছে ভারত, বিশেষ করে ফ্রান্স, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হলেও সিপ্রির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের কাছ থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ অস্ত্র কিনেছে ভারত।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক দৃঢ়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশ দুটির মধ্যে প্রতিরক্ষা বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাশিয়ার অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা পুনর্বিবেচনা করছে ভারত?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তনে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের মতো দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তা সত্ত্বেও, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকে কার্যত রাশিয়ার পাশেই দাঁড়ায় ভারত। যদিও দিল্লির দাবি, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটে তারা কোনো পক্ষ নিতে চায় না।
তবে অনেক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কাছে মস্কোর ওপর নির্ভরতা কমানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। স্টিমসন সেন্টারের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক সমীর লালওয়ানির মতে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার যে ক্ষতি হয়েছে, এরপর দেশটি ভারতের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হতে পারে। কারণ, রাশিয়া তার নিজস্ব বাহিনীর চাহিদা পূরণ করার জন্য ‘অস্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠতে পারে’।
রাশিয়ার অস্ত্র ছাড়া ভারত চলতে পারবে?
গত বছরের অক্টোবরে মার্কিন কংগ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারতীয় সামরিক বাহিনী রাশিয়ার সরবরাহ করা সামরিক সরঞ্জাম ছাড়া তাদের বাহিনীকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারবে না। খুব শিগগিরই তারা রাশিয়ান অস্ত্র ব্যবস্থার ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে পারবে না।’
রাশিয়া তুলনামূলক আকর্ষণীয় দামেই তাদের অস্ত্র সরবরাহ করে থাকে বলেও মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। দিল্লিভিত্তিক এভিয়েশন অ্যান্ড ডিফেন্স ইউনিভার্সের সম্পাদক সঙ্গীতা সাক্সেনার মতে, ভারতীয় সেনাবাহিনী রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনা অব্যাহত রাখবে। তবে ভারত নিজ দেশেই তার প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ ঘটাতে চায় বলেও জানান তিনি।