সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারে চেয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তপ্ত দেশ। চলছে নানা আলোচনা। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। তবে কোটা সংস্কারের বিষয় নতুন নয়। এটি সংস্কারে সুপারিশ এসেছে বার বার।
শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা সব গ্রেডে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও বলছেন, কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে সময়ের বিবেচনায় সংস্কার করা উচিত।
জানা গেছে, সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) দেড় দশক আগে এ বিষয়ে কিছু সুপারিশ করেছিল। তখন তা বাস্তবায়ন হয়নি। আবার ছয় বছর আগে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি এ নিয়ে কিছু সুপারিশ করেছিল। বিভিন্ন গবেষণাও হয়েছে বিষয়টি নিয়ে। সেগুলোতে নানাভাবে কোটা সংস্কার বা পর্যালোচনার কথা এসেছে।
তবে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে ঐ বছর নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করা হয়।
পিএসসির পুরোনো বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে যা জানা গেছে-
২০০৯ সালের মার্চে কোটা প্রয়োগের পদ্ধতির ওপর বিস্তারিত পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ শেষে কোটা প্রয়োগের পদ্ধতি সহজ করার বিষয়ে সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ করেছিল পিএসসি।
ঐ সুপারিশের মধ্যে ছিল মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অগ্রাধিকার কোটাগুলো জাতীয় পর্যায়ে বণ্টন করা যেতে পারে। অর্থাৎ ঐ কোটাগুলোকে পুনরায় জেলা বা বিভাগভিত্তিক ভাগ করা যাবে না বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্য পদের সর্বোচ্চ সংখ্যা দিয়ে সীমিত করা যাবে না।
এ ধরনের কোটার পদগুলো জাতীয়ভিত্তিক নিজস্ব মেধাক্রম অনুযায়ী ঐ কোটায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে।
পিএসসির ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে কোটার প্রয়োগকে অত্যন্ত জটিল, দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার উল্লেখ করে পিএসসি বলেছিল, কোটা প্রয়োগের পদ্ধতি সহজ করা একান্ত আবশ্যক।
ঐ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছিল, কোটাপদ্ধতির জটিলতার কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব। প্রার্থীদের বিভিন্ন ক্যাডারের চাকরির পছন্দক্রম এবং কোটার সঙ্গে বিভিন্ন জেলা বা বিভাগের জন্য আরোপিত সংখ্যাগত সীমারেখা সংযুক্ত হয়ে এমন একটি বহুমাত্রিক সমীকরণ কাঠামোর সৃষ্টি করেছে, যার নির্ভুল সমাধান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রায় অসম্ভব। পিএসসি বলেছিল, কম সময়ে ও সুচারু এবং নির্ভুলভাবে বিসিএস পরীক্ষাসহ নন-ক্যাডারে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা প্রয়োগের পদ্ধতি সহজ করা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায় কোটা প্রয়োগসংশ্লিষ্ট জটিলতা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
পিএসসির ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও একই ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল।
পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরির ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে নিয়োগ হতো কোটায়।
১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ যোগ করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ।
“বাছাই, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করার পর কোটা বিবেচনা করার নিয়ম। একসময় কোটার অনেক পদ শূন্য থাকত। যদিও পরে নিয়ম চালু করা হয়—কোটায় পদ পাওয়া না গেলে তা মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।”
কোটা সংস্কার নিয়ে যা বলেছেন আদালত
নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগে কোটা বাতিলসংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্র গত ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ের মূল অংশ গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে। এই রায়ের মূলকথা হলো, সব কোটা বজায় রাখতে হবে। তবে প্রয়োজনে বাড়ানো-কমানো যাবে। অবশ্য আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।
কোটা নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি-
এখন সরকারের ভেতরও কোটা সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে যেহেতু নির্বাহী বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাওয়া হয়েছে, তাই আদালতের সিদ্ধান্তের পরেই সরকার এ বিষয়ে করণীয় কিছু করতে পারে বলে মনে করে সরকার।
আপিল বিভাগের রায়ের আগে সরকার কোটা পরিবর্ধন-পরিমার্জন নিয়ে কিছু করবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি বিচারাধীন বিষয়, আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। গত শনিবার আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের অনেক দাবি ও বক্তব্য সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বিরোধী। সাংবিধানিক রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির আওতায় প্রণীত কোনো সরকারি নীতি শিক্ষার্থীদের একটা অংশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন হতে পারে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সংবিধানের আলোকেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনা-সম্পর্কিত সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সুযোগের সমতা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। অথচ গত কয়েক বছরে কোটা না থাকায় সরকারি চাকরিতে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি হতাশাজনকভাবে কমে গেছে। পুলিশে মাত্র চারজন নারী কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারে পেয়েছেন দুজন। ৫০টি জেলার নারীরা ক্যাডার পাননি। ২৩ জেলা থেকে কেউ পুলিশ ক্যাডার পাননি।
চাকরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া জানিয়েছেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংস্কার করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, কোটার বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। তাই আদালতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।
২০১৮ সালে মন্ত্রিপরিষদ কমিটির সুপারিশে যা বলা হয়-
ঐ সময় শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করে সরকার।
বাতিলের আগে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে যে কমিটি করা হয়েছিল, তারা এই পাঁচ গ্রেডে কোটা বাতিলের সুপারিশ করেছিল। ঐ কমিটি কোটা বাতিলের ফলে কোটার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে পর্যালোচনা করে পাওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ারও সুপারিশ করেছিল।
এর মানে হলো, ঐ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কোটা পর্যালোচনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে।
যে তিন সুপারিশ করেছিলো ঐ কমিটি-
১. নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া।
২. এসব গ্রেডে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি বাতিল করা এবং
৩. কোটা বাতিলের ফলে কোটার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময়ে পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া।
অর্থাৎ প্রথম দুটি সুপারিশের মূলকথা হলো, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোটা থাকবে না। এসব পদে নিয়োগ হবে সরাসরি মেধার ভিত্তিতে।
আর ঐ কমিটির তৃতীয় সুপারিশটির ব্যাখ্যা হলো, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোনো পরিবর্তন দেখা দেয় যে কোটা অপরিহার্য, তবে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারবে। বিষয়টি অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
এ বিষয়ে ঐ কমিটির প্রধান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, তৃতীয় সুপারিশের ব্যাখ্যা হলো, কোটা বাতিলের পর কী প্রভাব পড়েছে, সেটি পর্যালোচনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী সমন্বয় করা।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে কোটাব্যবস্থার ওপর গবেষণা করে তা কমানোর সুপারিশ করেছিলেন প্রয়াত মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান ও সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) উদ্যোগে গবেষণাটি করা হয়েছিল।
ঐ গবেষণায় বলা হয়, অগ্রাধিকার কোটা কোনোভাবেই মেধা কোটার চেয়ে বেশি হতে পারে না। তবে সেই গবেষণার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।
সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড আছে। সরাসরি নিয়োগ হয় মূলত নবম থেকে ২০তম গ্রেডে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এসব চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। ঐ বছর নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করা হলেও ১৪তম থেকে ২০তম গ্রেডে (মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) কোটা আগেও ছিল, এখনো আছে। যদিও প্রতিষ্ঠানভেদে এসব পদের কোটায় কিছু ভিন্নতা আছে।