সুনামিতে হারানো স্ত্রীকে ১৩ বছর ধরে সাগরের তলে খুঁজছেন স্বামী

সুনামিতে হারানো স্ত্রীকে ১৩ বছর ধরে সাগরের তলে খুঁজছেন স্বামী

চিত্র-বিচিত্র স্পেশাল

জুন ২৭, ২০২৪ ৯:২০ পূর্বাহ্ণ

সাগরে ডুব দিয়ে মণি-মুক্তা বের করে নিয়ে আসেন ডুবুরিরা। কিন্তু জাপানের সাবেক সেনা সদস্য ইয়াসৌ তাকামাতসু প্রলঙ্করী ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া স্ত্রীর খোঁজে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে সাগরে ডুব দিয়ে যাচ্ছেন। সাগরে ডুব দিতে দিতে গায়ের চামড়া মলিন হয়ে গেছে তার। তবু হার মানছেন না তিনি। খুঁজে বের করতেই হবে স্ত্রীকে- যেন মনে মনে এমন পণই করেছেন তিনি।

তাকামাতসুর বয়স এখন ৬৭ বছর। ২০১১ সালে জাপানের ওনাগাওয়ায় প্রলয়ঙ্করী সুনামির পর তার স্ত্রী ইয়োকো নিখোঁজ হয়। শেষবারের মতো স্বামীকে পাঠানো ক্ষুদে বার্তায় ইয়োকো লিখেছি,‘ তুমি কী ঠিক আছ? আমি বাড়ি যেতে চাই।’

স্ত্রীর সেই কথামালাই তাকামাতসুকে ইয়োকোর খোঁজে এতটা পথ নিয়ে এসেছে। ১৩ বছর পর আজও স্ত্রীকে খুঁজে ফিরছেন তাকামাতসু।

১১ মার্চ ২০১১। জাপানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী সুনামি (সাগরের ঢেউ)। এতে দেশটির উত্তর–পূর্ব উপকূলের বড় অংশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মারা যান ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। নিখোঁজ হন অনেকে। ইয়োকোও তাদেরই একজন।

আমি ভেবেই ছিলাম, এটি কঠিন কাজ। বাস্তবেও খুব কঠিন পেয়েছি। কিন্তু স্ত্রীকে পেতে আমার সামনে একমাত্র এ কাজটিই রয়েছে। তার খোঁজে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আমার নেই। সাগরে গেলে আমি তাকে খুব নিবিড়ভাবে অনুভব করি।

ইয়োকোকে উদ্ধারে গভীর সাগরে নামার জন্য ৫৬ বছর বয়সে ডাইভিং শেখার সিদ্ধান্ত নেন ইয়াসু। এরপর ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬০০ বার সাগরে নেমে ইয়োকোকে খুঁজেছেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত তার দেহাবশেষের সন্ধান এখনো পাননি। যা হোক, ইয়োকোর জন্য অক্ষয় ভালোবাসা তাকামাতসুকে এতটুকু হতোদ্যম করতে পারেনি। তার বিশ্বাস, একদিন না একদিন তাকে খুঁজে পাবেন তিনি।

সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইয়োকো–ইয়াসু জুটির প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৮৮ সালে। তখন ইয়োকো ২৫ বছরের তরুণী। কাজ করতেন ওনাগাওয়ার সেভেনটি সেভেন ব্যাংকে। অন্যদিক তাকামাতসু ছিলেন জাপানের গ্রাউন্ড সেলফ–ডিফেন্স ফোর্সের একজন সেনা। ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ইয়োকোর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন।

প্রথম সাক্ষাতেই পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলেন ইয়োকো-ইয়াসু। একপর্যায়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ইয়াসু তার স্ত্রীর ব্যাপারে বলেন, ‘ও ছিল ভদ্র। আমি তার হাসি ও বিনয়ী স্বভাব পছন্দ করতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইয়োকো ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত শুনতে ভালোবাসত। ছবি আঁকায় ছিল প্রবল ঝোঁক। ক্যানভাসে ব্যবহার করত জলরং। তবে এসব ছবি আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখাত না।’

সাগরে হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর দেহাবশেষের সন্ধান তাকামাতসুর জন্য কোনো সহজ কাজ নয়; তা–ও যখন ১৩টা বছর পেরিয়ে গেছে। একরকম দুঃসাধ্য এ কাজ চালিয়ে যেতে অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কেননা বিস্তীর্ণ সাগরের নিচ থেকে ইয়োকোর দেহাবশেষ বের করে আনার কাজ যেন বিরাট খড়ের গাদা থেকে সুচ বের করে আনা। কিন্তু তাকামাতসু নাছোড়বান্দা। তিনি বলেন, ‘৫৬ বছর বয়সে আমি ডাইভিং শিখেছি এ কারণে যে আমি সাগর থেকে আমার স্ত্রীকে খুঁজে বের করে আনতে চাই।’

কাজটা যে সহজ নয় তা স্বীকার করেন তাকামাতসুও। বলেন, ‘আমি ভেবেই ছিলাম, এটি কঠিন কাজ। বাস্তবেও খুব কঠিন পেয়েছি। কিন্তু স্ত্রীকে পেতে আমার সামনে একমাত্র এ কাজটিই রয়েছে। তার খোঁজে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আমার নেই। সাগরে গেলে আমি তাকে খুব নিবিড়ভাবে অনুভব করি।’

‘তুমি কি ঠিক আছো? আমি বাসায় যেতে চাই’—স্ত্রী ইয়োকোর কাছ থেকে ইয়াসুর শোনা সর্বশেষ কথা এটি। এ কথাটুকুই তার খোঁজে ইয়াসুকে আজও সাগরে ছুটে যেতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। স্ত্রীকে খুঁজে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যেতে চান তিনি।

সুনামির কয়েক মাস পর তাকামাতসু স্ত্রীর মুঠোফোন তার কর্মস্থলের গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানে পান। মুঠোফোনে একটি খুদে বার্তা লেখা ছিল; যদিও সেটি সময়মতো পাননি তিনি। বার্তায় লেখা ছিল, ‘অনেক বড় সুনামি।’

সাগরে ভেসে যাওয়া মরদেহের বিষয়ে কথা বলেছেন সেন্দাইয়ে তোহোকু মেডিকেল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনিভার্সিটির ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট তেতসুইয়া তাকাগি।

তেতসুইয়া বলেন, ‘কোনো মরদেহ সাগরে ভেসে হারিয়ে গেলে সে ব্যাপারে কিছু বলা কঠিন। তা সাগরের ঢেউয়ে ভেসে কোন দিকে যাবে, কেউ বলতে পারে না। অবশ্য একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় মরদেহ ডুবে থাকলে সেখানে তা রয়ে যেতে পারে। আবার সেখানেও সেটি অক্ষত না থাকতে পারে।’

এদিকে ইয়াসু তাকামাতসুর জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে এটি প্রদর্শনও করা হয়েছে। ‘নোহয়ার টু গো বাট এভরিহয়ার’ (কোথাও যাওয়ার নেই, কিন্তু সবখানেই) শিরোনামের এ তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন এরিক শিরাই ও মাসাকো সুমুরা।

সূত্র: গাল্ফ নিউজ, ইউনিল্যাড ডটকম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *