সুদানে ক্ষমতা দখলে দুই জেনারেলের লড়াই

সুদানে ক্ষমতা দখলে দুই জেনারেলের লড়াই

আন্তর্জাতিক

এপ্রিল ১৮, ২০২৩ ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সুদানজুড়ে চলছে ভয়াবহ সামরিক-আধা সামরিক লড়াই। গত শনিবার থেকে তাদের মধ্যে এ লড়াই শুরু হয়। তিন দিনের লড়াইয়ে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। আহত হচ্ছে শত শত মানুষ। দেশজুড়েই ভয়ংকর এক থমথমে অবস্থা। মাত্র দুজন ব্যক্তির কারণে রীতিমতো টগবগ করে ফুটছে প্রায় চার কোটি ৬৫ লাখ মানুষের এ ভূখণ্ড। একজন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। অন্যজন আধা সামরিক র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেদতি। দেশটির প্রধান দুই সশস্ত্র শক্তির দুই জেনারেলের উচ্চাভিলাষী রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ দ্বন্দ্বেই দরিদ্রপীড়িত দেশটিতে সংঘর্ষের মূল কারণ।

কিছু দিন আগেও মিত্রতার সম্পর্ক ছিল। বন্ধু বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। ২০১৯ সালে সুদানের  সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এক সঙ্গে কাজ করেছিলেন এই দুই জেনারেল। ২০২১ সালে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানেও একত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা। দেশটিতে চলমান সহিংসতার সূত্রপাত বেসামরিক শাসন পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আরএসএফকে দেশের সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে আলোচনার সময়। নতুন অনুক্রমের অধীনে কে কার অধীনস্থ হবে তা নিয়ে মূল সমস্যা দেখা দেয়।

উভয়পক্ষ তখন থেকেই আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মেতে ওঠে। তবে সুদানে চলমান এমন বিশৃঙ্খলা নতুন নয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির দেশটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রায় তিন দশক। সেসময় দেশটিতে রুটির দাম বৃদ্ধির জেরে শুরু হওয়া বিক্ষোভ তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বশিরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী পশ্চিম অঞ্চল দারফুরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে তার শাসনামলে দক্ষিণ সুদান উত্তর সুদান থেকে বিভক্ত হয়ে যায়। বশিরের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সামরিক ও বেসামরিক  দ্বন্দ্বে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পড়েছিল সুদান। যা ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেষ হয়।

আরএসএফের বিতর্কিত অতীত 
সুদানের প্রধান আধা সামরিক গোষ্ঠী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স।  ক্ষমতার দ্রুত উত্থান ঘটিয়েছিলেন আরএসএফ জেনারেল দাগালো। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে সুদানের দারফুর সংঘাতের সময় তিনি সুদানের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নৃশংসতার সাথে জড়িত কুখ্যাত জানজাওয়েদ  বাহিনীর নেতা ছিলেন। দলটির প্রতি আন্তর্জাতিক ক্ষোভ দেখা দিলে বশির এটিকে বর্ডার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নামে আধা সামরিক বাহিনীতে পরিণত করেন। ২০০৭ সালে এই দলের সৈন্যরা দেশের গোয়েন্দা পরিষেবার অংশ হয়ে ওঠে। এরপর ২০১৩ সালে বশির তার তত্ত্বাবধানে ও দাগালোর নেতৃত্বে একটি আধা সামরিক গোষ্ঠী আরএসএফ তৈরি করেন। পরে দাগালো ২০১৯ সালে বশিরের বিরোধিতা করেন ও কমপক্ষে ১১৮ জনকে হত্যা করেছিলেন সে সময়। পরে তিনি বেসামরিক নেতৃত্বের সাথে অংশীদারত্বে সুদান শাসনকারী অন্তর্র্বর্তী সার্বভৌম কাউন্সিলের ডেপুটি নিযুক্ত হন।

দুই প্রতিদ্বন্দ্বী একে অপরের প্রতিবিম্ব
প্রেসিডেন্ট বশিরের পতনের সময় বুরহান সেনাবাহিনীর ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন। তার পেশায়ও রয়েছে দাগালোর মতো কলঙ্কের দাগ। ২০০০-এর দশকে দারফুর সংঘাতের সময় তার ভূমিকার জন্যও সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। আল-বুরহান এবং হেমেদতি উভয়ই উপসাগরীয় শক্তিশালীগুলোর অনুগ্রহে তাদের ক্ষমতার ভিত শক্ত করেছিল। তারাই এখন আটকে আছে নিজেদের ক্ষমতার দখলের দ্বন্দ্বে। একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি এখন সুদান। উভয়পক্ষই দেশের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করছে। রাজধানী খার্তুম ছাড়া অন্য অঞ্চলগুলোতেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে সিএনএনের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সুদান থেকে সেনা পাচারে কীভাবে রাশিয়া দেশটির সামরিক নেতাদের সাথে যোগসাজশ করেছিল। দাগালোর বাহিনী ছিল রুশ প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের প্রধান প্রাপক। সুদানের সামরিক নেতা বুরহানকেও রুশ সমর্থিত বলে বিশ্বাস করা হয়। সুদানের প্রতিবেশী মিসর এবং দক্ষিণ সুদান মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা দুই লাখ ১০ হাজার থেকে দুই লাখ ২০ হাজার প্রায়। এর মধ্যে আরএসএফের সংখ্যা মাত্র ৭০ হাজার।

কয়েক বছর ধরেই দেশ চালাচ্ছেন বুরহান
কয়েক বছর ধরেই সুদানের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হন।

গণবিক্ষোভের জেরে ২০১৯ সালের এপ্রিলে সুদানের প্রেসিডেন্ট আল-বশিরকে উৎখাত করে দেশটির সেনাবাহিনী। এর মধ্য দিয়ে তার প্রায় ৩০ বছরের একনায়ক শাসনের অবসান ঘটে। তখন বুরহান ছিলেন সেনাবাহিনীর মহাপরিদর্শক। সে সময় সুদানের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ জেনারেলদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল তৃতীয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল (টিএমসি)। এক পর্যায়ে বুরহানকে টিএমসির প্রধান করা হয়।

মাস কয়েক পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে টিএমসি বদলে গঠন করা হয় সার্বভৌম পর্ষদ (এসসি)। সামরিক-বেসামরিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গঠিত এই পর্ষদ। এই পর্ষদ ২০১৯ সাল থেকে সুদান চালাচ্ছে।

সার্বভৌম পর্ষদ গঠনের পর তার প্রধান হন বুরহান। পর্ষদের উপনেতা আরএসএফের প্রধান হেমেদতি। সার্বভৌম পর্ষদের নেতা হিসাবে বুরহান কার্যত সুদানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। এই পর্ষদ দেশটির গণতন্ত্রপন্থি বেসামরিক শক্তিগুলোর সঙ্গে কাজ করে আসছিল। ২০২১ সালে বুরহান ও হেমেদতি অভ্যুত্থান করে বসেন। তারা সুদানের ক্ষমতা দখল করেন। এতে সুদানের গণতন্ত্রে ফেরার প্রক্রিয়া লাইনচ্যুত হয়। সুদানের কার্যত রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে বুরহান সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও মিসরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই দেশগুলোই বশিরকে উৎখাতে সামরিক জেনারেলদের উৎসাহিত করেছিল। একপর্যায়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সামরিক বাহিনী ও আরএসএফ। এই দ্বন্দ্বের জেরে দুপক্ষের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সুদানে সবশেষ যে সহিংসতার সূত্রপাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *