সিনেমা বাঁচাবো নাকি সিনেমা হল?

সিনেমা বাঁচাবো নাকি সিনেমা হল?

বিনোদন

মার্চ ১৭, ২০২৩ ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

একটা সময়ে দেশে হাজারের ওপর সিনেমা হল ছিল। মানুষ বিনোদন বলতে সিনেমা দেখাকেই বুঝতো। কালের বিবর্তনে বিনোদনের মাধ্যম বদলে যায়। মানুষ অনেকটাই হলবিমুখ হয়ে পড়ে। অশ্লীলতা গ্রাস করে সিনেমাঙ্গন। কমতে থাকে হলের সংখ্যা। এখন সারাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি সিনেমা হল রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে যে কয়েকটি ছবি মুক্তি পায়, সেগুলোও দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে ধুঁকছে সিনেমাঙ্গন। এখন দাবি উঠেছে হিন্দি সিনেমা আমদানি করার। তবেই বাঁচবে সিনেমা হল। তবে হিন্দি সিনেমা আমদানির বিরোধিতাও কম হচ্ছে না। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তিতে এসব বিষয়ে আলাপ করেছেন কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা।

বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব, জড়িত ছিলেন- গ্রুপ থিয়েটার, প্যাকেজ নাটক আন্দোলনসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে। তিনি সরকারি অনুদানে নির্মাণ করছেন নতুন ছবি ‘যাপিত জীবন’। তিনি মনে করেন চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। বাংলাদেশের সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বব্যাপী। বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের যে কোনো পণ্যের প্রতি পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষের ভালোবাসা রয়েছে। আমাদের কিছু মানুষের অসহযোগিতা, মনোপলির কারণে আমরা পিছিয়ে গেছি। দেখুন, একটা সময় যখন চলচ্চিত্র তুঙ্গে ছিল তখন ক্রিকেটের খোঁজ তেমন কেউ নিতো না। এখন ক্রিকেট এমন পর্যায়ে গেছে যে, সবাই পছন্দ করে। চলচ্চিত্রকেও এ পর্যায়ে নিতে হবে। আমাদেরকে সেন্সরশিপের বিষয়ে আরো শিথিল হতে হবে। বিএফডিসিকে সহনশীল হতে হবে। এটা করা যাবে না ওটা দেখানো যাবে না– এরকম শর্ত দিয়ে সৃষ্টিশীল কাজ হয় না। আমাদের অ্যাপ্রোচ বদলাতে হবে। নতুন বিষয়বস্তু নিয়ে সিনেমা বানাতে হবে, যা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। এমন সিনেমা বানাতে হলে উচ্চারণ, সংলাপ প্রক্ষেপণ, টোটাল আর্ট ও অভিনয়ের গাইডলাইন প্রয়োজন। আমরা এককালে টিএসসিতে কবিতা আবৃত্তি করতাম। উচ্চারণের কাজ করতাম। এখন তা হয় না। অথচ একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হয়ে উঠতে হলে এসবের চর্চা দরকার।

হাবিব দম নিয়ে আরো বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সিনেমাবান্ধব। তিনি থাকতে চলচ্চিত্রের ক্ষতি হবে না। প্রয়োজন মতপার্থক্য দূর হওয়ার। প্রয়োজন ৩০০ সংসদীয় আসনে সিনেপ্লেক্স। প্রচারণা করতে হবে। জাতিকে জানাতে হবে আগের সেই অশ্লীলতা এখন নেই। রুচিশীল দর্শককে নিয়মিত হলে ফিরিয়ে আনতে হবে। অসভ্যদের এই অঙ্গন থেকে দূর করতে হবে। তখন সিনেমাও থাকবে, সিনেমা হলও থাকবে।

চলচ্চিত্র অভিনেতা ও নির্মাতা খিজির হায়াত খান পরিচালিত ছবি ‘ওরা সাত জন’। মুক্তিযুদ্ধের গল্পে নির্মিত ছবিটি দর্শকের প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। এ নির্মাতা মনে করেন সমস্যার মূলে নজর দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমরা মূল সমস্যা ঠিক না করে বাহ্যিক জিনিস নিয়ে পড়ে আছি। হল বাঁচানোর জন্য বাইরের সিনেমা আনার যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সেসব ঠুনকো যুক্তি। এতে করে লাভবান হবেন গুটিকয়েক মানুষ। তাদের লাভের জন্য হিন্দি সিনেমা আনলে বাংলা ছবি চালানো যাবে না। এটাই তো স্বাভাবিক, যখন হিন্দি সিনেমা ব্যবসা করবে তখন প্রদর্শকরা বাংলা সিনেমা চালাতে চাইবেন না। গত ১৫ বছর ধরে এ জায়গা এমনভাবে চালিয়েছি, যার কারণে এখন ধ্বংসে হয়ে পড়েছে। আমাদেরকে শর্ট টার্ম নয়, লং টার্মে ভাবতে হবে।

হতাশ কণ্ঠে খিজির হায়াত খান আরো বলেন, বাংলা সিনেমার এ অবস্থার জন্য আমরা সবাই দায়ী। তথাকথিত চলচ্চিত্র নেতারা নিজেদের স্বার্থে কাজ করেছেন। চলচ্চিত্রকে বাঁচানোর কার্যকর পদক্ষেপ তারা নেননি। এখনো আমাদের ই–টিকিটিং ব্যবস্থা নেই। ডিস্ট্রিবিউশনের সঠিক পলিসি নেই। আমরা বিভিন্ন খাতে প্রচুর খরচ করছি। অথচ সিনেমার জন্য অর্থাৎ শিল্পের জন্য বাজেট বাড়ানো হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই না ভাবলে বাংলা সিনেমার কবর রচিত হবে।

তরুণ নির্মাতা সাজ্জাদ খান তার প্রথম ছবি ‘সাহস’ প্রেক্ষাগৃহে চালাতে পারেননি। তিনি এরই মধ্যে শেষ করেছেন পরবর্তী ছবি ‘কাঠগোলাপ’– এর কাজ। ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে সিনেমাও হতে হবে, সিনেমা হলও থাকতে হবে। পরিতাপের বিষয়, দেশে এখনো বক্স অফিস নেই। আমরা সিনেপ্লেক্স ছাড়া অন্য হলগুলোর সঠিক হিসাব পাই না। আমাদের এত বড় বড় হলের তো প্রয়োজন নেই। দেশের বাইরে এখন ছোট সিনেমা হল গড়ে উঠছে। আমাদেরও সেদিকে যেতে হবে। যদি হল কর্তৃপক্ষ সঠিক হিসাব দেন, তাহলে দর্শক যা দেখবেন নির্মাতারা তাই বানাবেন।

তিনি বলেন, সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ অনেক বুদ্ধি দেন। হল সংখ্যা হাজার থেকে কমতে কমতে একশোর নিচে নেমেছে। তারা যদি এতোই বোঝেন তাহলে সিনেমা তৈরি করুক। পরিচালনাও তারাই করুক। আরেকটা ব্যাপার হলো সেন্সরবোর্ড। আমাদের হাত-পা বেঁধে সিনেমা বানাতে বললে তো সিনেমা হবে না। সেন্সরবোর্ডকে ঠিক করতে হবে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সমস্যার সমাধান করতে হবে। সময়ের সঙ্গে সবকিছুর পরিবর্তন হয়। আগে ভিসিআর ছিল। তারপর এলো ভিসিডি। এখন ইউটিউবের যুগ। যুগের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। বর্তমানে সিনেমা হলের যে ধারণা সেটিও পরিবর্তিত হবে বলে মনে করি।

তিন নির্মাতার কথায় উঠে এসেছে সবার আগে সেন্সরবোর্ডকে ঠিক হতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ্ব করতে হবে। চালু করতে হবে বক্স অফিস। তাহলে ধীরে ধীরে সিনেমার সুদিন ফিরবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *