সাড়া নেই অনলাইন পশুর হাটে

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জুলাই ১, ২০২২ ১০:০৪ পূর্বাহ্ণ

মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র দশ দিন। অথচ এখনও জমে ওঠেনি অনলাইন পশুর হাট। গত দু-বছরের ন্যায় এ বছর অনলাইন পশুর হাটে আশানুরূপ সাড়া নেই বলে জানিয়েছেন ডেইরি ফার্মের মালিকরা। তারা বলছেন, ইভ্যালি, কিউকম, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, আলাদিনের চেরাগ, আলেশা মার্টের প্রতারণার কারণে সাধারণ মানুষের আস্থা কমে গেছে। এছাড়াও করোনার সংক্রমণ কমে যাওয়ায় অনলাইন পশুর হাটে মানুষের আগ্রহ কমে গেছে।

এদিকে অনলাইনে পশুর হাটে সাড়া না মিললেও এবার সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানীতে ২২টি পশুর হাট নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১০টি ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১২টিসহ সারা দেশে ৪ হাজার ৪০৭টি পশুর হাট বসবে। এ সংখ্যা হয়তো দু-একটা কমবেশি হতে পারে।

গবাদিপশু হাটে ওঠানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রান্তিক খামার থেকে বড় খামারিরা। গত দু-বছর মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে অনলাইনের পশুর হাট-বাজার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সোশাল মিডিয়া, বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট আর সরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল হাট তৈরি হয়েছে। এছাড়াও কিছু উদ্যোক্তা ফেসবুকে লাইভে এসে পশু বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পশু কোরবানি করে মাংস বাসায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাও রেখেছে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাদিক এগ্রো’র কর্নধার মো. ইমরান হোসেন বলেন, গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে সবচেয়ে কম কোরবানি হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খামারি ও ডেইরি মালিকরা। আশা করা হচ্ছে, এ বছর এটা হবে না।

অনলাইনে পশুর হাটের বিষয়ে তিনি বলেন, গত বছর সারা দেশে সাড়ে ৩ লাখ গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে। যার বাজারমূল্য আড়াই হাজার কোটি টাকা। এ বছর অনলাইনে সাড়া কম পাচ্ছি। ইভ্যালি, কিউকম, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, আলাদিনের চেরাগ, আলেশা মার্টের প্রতারণার কারণে মানুষের আস্থা কমে গেছে। গত বছর যত সংখ্যক অনলাইনে বিক্রি করেছি, এ বছর আমার সাদিক এগ্রো থেকে ৫ শতাংশও বিক্রি হয়নি। মানুষ সরাসরি এসে দেখে যাচ্ছে, অনেকে বুকিং দিয়ে যাচ্ছে।

রয়েল র‍্যাঞ্চ অ্যান্ড ডেইরি ফার্মের কর্ণধার আবদুস সালাম বলেন, গত বছর অনলাইনে অনেক গরু বিক্রি করেছি। এ বছর করোনার সংক্রমণ কম থাকায় মানুষ সরাসরি ফার্মে আসছেন।

তবে দারাজের চিফ মার্কেটিং অফিসার মো. তাজদীন হাসান বলেন, পঞ্চমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে দারাজের ডিজিটাল কোরবানির হাট। ক্রেতারা দারাজ থেকে দুই শতাধিক গরু ও ছাগল বাছাই করে নিতে পারবেন। এবার দারাজে থাকছে ফ্রি ডেলিভারি সুবিধা। নির্দিষ্ট ব্যাংক পার্টনারের মাধ্যমে পেমেন্ট করলে ক্যাশব্যাক থাকছে। কিছু গরুর সাথে পাচ্ছেন ফ্রি ডিপ ফ্রিজ। কোভিড সংক্রমণ বিধিনিষেধের কারণে এবার অনেকেই দারাজ থেকে গরু ও ছাগল কিনছেন। এবারও ভালো সাড়া মিলছে। দারাজের সবাই আশাবাদী যে এই বছর আরও অনেকেই অনলাইনে গরু ও ছাগল অর্ডার করবেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর জানায়, এ বছর ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে গরু ৪৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৯, মহিষ ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০৪, ছাগল ৬৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯১৫, ভেড়া ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬৮২ ও অন্যান্য ১ হাজার ৪০৯টি। ২০২১ সালে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে কোরবানি হয়েছে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উপপরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা বলেন, এ বছর কোরবানির জন্য আমাদের পর্যাপ্ত গবাদিপশু রয়েছে। আশা করছি, ঘাটতি হবে না।

অনলাইন পশু বিক্রির বিষয়ে তিনি সময় সংবাদকে বলেন, আইসিটি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল হাট করেছে। সেখানে খামারিদের কাছ থেকে পশু সংগ্রহ করবে। সেক্ষেত্রে আমাদের ভেটেনারি সার্জনের সনদ নেয়া লাগবে। সনদ ছাড়া কোনো পশু ডিজিটাল হাটে নেয়া হবে না।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশের আট বিভাগের মধ্যে বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট, এই চার বিভাগে গবাদিপশুর ঘাটতি রয়েছে। আর প্রয়োজনের তুলনায় অধিক রয়েছে ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে।

ই-ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর চালু হওয়া অনলাইন হাট থেকে বেচাকেনা হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার গরু-ছাগল ও অন্যান্য পশু। আর অনলাইন থেকে ছবি দেখে পরে সরাসরি কৃষকের বাড়ি ও খামার থেকে এসব পশু বিক্রি হয়েছে।

ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, এ বছর করোনার সংক্রমণ কম থাকায় অনলাইন পশুর হাটে মানুষের আগ্রহ কম। আমরা আশা করছি, দুই লাখের বেশি কোরবানির পশু বিক্রি হবে।

ডিজিটাল হাট

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে এবারের ডিজিটাল কোরবানির হাট বাস্তবায়ন করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)। এতে কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে এটুআইর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম একশপ। আগামী ১ জুলাই ডিজিটাল হাট উদ্বোধন করা হবে।

এ ছাড়া https://www.daraz.com.bd/ ২০১৭ সাল থেকে ‘গরুর হাট’ নামক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে কোরবানির পশু বিক্রি করে আসছে। তারা গরুর লাইভ ওয়েট, রং, দাঁত ইত্যাদি দেখে কেনার এবং ছবির পাশাপাশি খামার ও গরুর ভিডিও দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে ‘অনলাইন কোরবানির হাট’ শিরোনামে কোরবানির পশু বিক্রি করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অথবা ডটকম (www.othoba.co)।

আরেক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মিটের পাবনায় খামার রয়েছে। তবে রাজধানীসহ সারা দেশেই (https://qurbani.bengalmeat.com/) অনলাইনের মাধ্যমে তারা কোরবানির পশু সরবরাহ করছে। প্রিয়শপ ডটকম (priyoshop.co) আয়োজন করেছে ‘অনলাইন কোরবানি হাট’। পরিবারের সব সদস্যকে দেখিয়েই কেনা যাবে পশু।

এদিকে পশুর হাটে নিরাপদ ও সহজ লেনদেন নিশ্চিত করতে ডিএনসিসি এবার ছয়টি পশুর হাটে ডিজিটাল পেমেন্ট বুথ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাটগুলো হচ্ছে মোহাম্মদপুর (বছিলা), আফতাবনগর, ভাটারা, কাওলা, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর ও গাবতলী পশুর হাট।

এই ছয় হাটে ক্রেতারা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এটিএম মেশিন থেকে টাকা তুলে বিক্রেতাকে পশুর মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। এছাড়া বিকাশ ও ইসলামী ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং এম ক্যাশের মাধ্যমেও মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন ক্রেতারা। এসব হাটে ডিজিটাল লেনদেন করলে বাড়তি খরচের প্রয়োজন হবে না। যেমন কার্ড ব্যবহারে কোনো চার্জ নেয়া হবে না। আবার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা তুলতে ক্যাশ আউট খরচ লাগবে না।

গত দুই বছর ডিএনসিসি অনলাইন কোরবানির পশুর হাট কার্যক্রম চালু করেছিল। এবার করোনা মহামারির প্রকোপ কিছুটা কম থাকায় অনলাইনে পশুর হাটের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাছাড়া গত দুই বছরে অনলাইনে পশুর হাট ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা সুখকর না হওয়ায় এবার স্মার্ট হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএনসিসি।

ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রাথমিকভাবে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় এই কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এই ছয়টি হাটে পেমেন্ট পার্টনার হিসেবে কার্ড স্কিম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড, ভিসা ও আমেরিকান এক্সপ্রেস ডিজিটাল পেমেন্ট বুথ স্থাপন করবে। এ ছাড়া ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক- ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড হাটে বুথ স্থাপন করবে। অন্যদিকে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে বিকাশ লিমিটেড ও ইসলামী ব্যাংক এম ক্যাশের মাধ্যমে হাটে টাকা তোলার সুযোগ থাকছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *