রিকশা : ঢাকার শৈল্পিক বাহন

রিকশা : ঢাকার শৈল্পিক বাহন

ফিচার স্পেশাল

জানুয়ারি ১১, ২০২৩ ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

শহরের অলি-গলি কিংবা কোনো অজপাড়া গাঁ—কোথায় নেই রিকশা? কোনো ভিনদেশী যদি বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে পা রাখেন, তাহলে প্রথমেই তার চোখে পড়বে তিন চাকার বাহন রিকশা। মানব-চালিত মানববাহী এই বাহনটি বাংলাদেশের বাইরে আর কোনো দেশেই এতো পরিমাণে নেই। এজন্যই হয়তো ঢাকাকে ‘রিকশার নগরী’ বলেন অনেকে।

রিকশা লাখ লাখ মানুষের যেমন রুটিরুজি, তেমনি অসংখ্য মানুষের আয়েশে ঘোরার সবচেয়ে পছন্দের বাহনও। এই রিকশার কারণেই আমরা আলাদা শিল্পকর্ম পেয়েছি; যাকে বলা হয় ‘রিকশা আর্ট’। এই শিল্পকর্ম রিকশা থেকে ছড়িয়ে টিশার্ট, শাড়ি কিংবা মগেও স্থান পাচ্ছে।

বেশিরভাগ গবেষণা বলছে. রিকশার উদ্ভব হয়েছে জাপানে। আবার কোন কোন গবেষকদের মতে এই রিকশা তৈরি করেছেন মার্কিনীরা। রিকশা আবিষ্কারের সঠিক ইতিহাস নিয়ে এমন অনেক মতভেদ আছে। তবে বাংলাদেশে যে প্যাডেল দেওয়া সাইকেল রিকশার প্রচলন সেটা সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে বলে ইতিহাসবিদ ও গবেষক মুনতাসির মামুনের স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী ঢাকা বইটিতে উলে­খ করা হয়েছে। তবে সেটি বর্তমান রিকশার মতো ছিল না।

কথিত আছে, মিয়ানমারের রেঙ্গুন থেকেই চট্টগ্রামে প্রথম রিকশা আসে ১৯১৯ সালের দিকে। এরপর রিকশা আসে ঢাকায়। তবে ঢাকার রিকশা এসেছিল ভারতের কলকাতা থেকে। ১৯৩০ এর দশকে। রিকশা আসার পর এই যান ঢাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক কৌত‚হল জাগায়। এরপর এই রিকশাই পৌঁছায় শিল্পের খাতায়।

শিল্প যখন পথেঘাটে সস্তায় বিকোয়, তখন শিল্পীর মর্যাদাও সস্তায়ই চুকে যায়। প্রতিদিন ধুলোমাখা পথে যে রিকশাগুলো ছড়িয়ে থাকে এদিক-ওদিক, তার পেছনটায় কী থাকে দেখেছেন তো? ঐ যে রঙ-বেরঙের ছবি আঁকা আয়তাকার পাতগুলো, ঐ যে রিকশা সাজিয়েছে ওরা বহু কারুকাজে- ওগুলোই রিকশাচিত্র বা রিকশা আর্ট।

রিকশা আর্ট সারাবিশ্বেই সমাদৃত। ছবি: সংগৃহীত

রিকশা আর্ট সারাবিশ্বেই সমাদৃত। ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৭-এর দেশভাগের পর প্রতিষ্ঠানভিত্তিক চারুকলার ধারার পাশাপাশি একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারাও গড়ে ওঠে। এর নেতৃত্ব দেন পীতলরাম সুর, আর কে দাস, আলাউদ্দিন, আলী নুর, দাউদ উস্তাদ প্রমুখ শিল্পী। এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীর মাধ্যমেই বিকশিত হয় এ দেশের রিকশা আর্ট। আর নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তায় ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে সুধীজনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এই রিকশা আর্ট।

রিকশা আর্টের মূল লক্ষ্য রিকশাকে সুসজ্জিত ও আকর্ষণীয় করা। সাধারণত শিল্পীরা মহাজন এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ছবি এঁকে থাকেন। তবে গত ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে রিকশা পেইন্টিং করা হয়েছে। যেমন, ষাটের দশকে রিকশা পেইন্টিং করা হতো মূলত শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র তারকাদের প্রতিকৃতি অবলম্বনে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু করে। আবার সত্তরের দশকে নতুন দেশের নতুন রাজধানী হিসেবে ঢাকা যখন বাড়তে শুরু করে, তখন কাল্পনিক শহরের দৃশ্য আঁকা হতো রিকশায়।

রিকশা আর্ট মানেই যে শুধু রিকশার পেছনে আঁকা থাকবে তা কিন্তু নয়। যদিও শুরুটা এ থেকেই, মূলত উজ্জ্বল রঙে আঁকা সুস্পষ্ট সাবলীল ও প্রাণবন্ত গঠনকে রিকশা আর্ট বোঝানো হয়। এর একটি নির্দিষ্ট ফর্ম বা গঠন আছে যা থেকে এটি যদি রিকশায় না এঁকে আপনার ঘরের দেয়ালেও আঁকা হয়, খুব সহজেই চেনা যাবে এটি রিকশা আর্ট!

দেশ-বিদেশের বড় বড় প্রদর্শনীতে হয়তো ঐতিহ্য হিসেবে ভালোয় দাম পায় রিকশা আর্ট। কিন্তু বাংলাদেশের একেবারে শেকড়ের যে রিকশাশিল্পীরা, তারা তো আর সেই দামের ছোঁয়াও পান না! তবে আমরা চাই শিল্প বেঁচে থাকুক, পথে-ঘাটে চলতে চলতে পুনরায় বেঁচে উঠুক রঙে রাঙানো রিকশা আর্টও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *