যুদ্ধ শেষে দুর্যোগের কবলে আফগানরা

আন্তর্জাতিক স্লাইড

জুলাই ১, ২০২২ ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। বছরের পর পর ধরে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছে দেশটি। গেল বছর মার্কিন বাহিনীকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে তালেবান। মানুষ ভেবেছিল—যুদ্ধ শেষে তারা স্বস্তির জীবন পাবে। কিন্তু এরইমধ্যে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পটি আঘাত হানে সেখানে। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। আকাশ থেকে বোমা না পড়লেও অনাবৃষ্টি, শীত, দাবদাহ ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের ধীরে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।

২২ জুনের ভূমিকম্পে নিহত হয়েছেন হাজারের বেশি মানুষ। আহত দেড় হাজার। শত শত বসতবাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। এসবের মধ্যেও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে যথেষ্ট পাশে পাচ্ছে না আফগানিস্তান। এতে সরকারের জন্য বিপর্যয় সামলে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিপর্যস্ত মানুষকে সহায়তার সামর্থ্যটুকুও সরকারের নেই।

তালেবান ক্ষমতায় এলে বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কাবুল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা আগেই আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেছে। তালেবান সরকারের স্বীকৃতি না মেলায় বিদেশি সহায়তাও বন্ধ। যে কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার কতটা সফল হবে; তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

অনাবৃষ্টি ও অর্থনৈতিক পতনের পরেও চলতি বছরে আফগানিস্তানের জন্য মানবিক সহায়তার আবেদনে তেমন সাড়া মেলেনি। ভূমিকম্পের পর প্রতিবেশী পাকিস্তান, ভারত, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নামে মাত্র সহায়তা পাঠিয়েছে। অর্থাৎ আফগান ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মুসলিম বিশ্বকে পাশে পায়নি তারা।

যদি মানবিক বিবেচনায় জরুরি ত্রাণকাজ পরিচালনা করতেও হয়, দেশগুলোকে সবার আগে মার্কিন অর্থ মনন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় আদায় করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে হবে—এটি কোনো উন্নয়ন সহায়তা না; কেবল দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

আফগানিস্তানের ব্যাংকখাতের ওপর অনেক দেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কোটি কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা উধাও। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকলেও তা নিতান্তই অপর্যাপ্ত। এক টুইটবার্তায় জ্যেষ্ঠ তালেবান কর্মকর্তা আনাস হাক্কানি বলেন, নিজের সক্ষমতার মধ্য দিয়ে সরকার কাজ করছে। এই বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের জনগণের পাশে দাঁড়াবে বলে আশা করছি।

তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর এক বছর হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সংকট পুরো দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। স্থানীয় বাজারে খাবারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ। ২২ জুন আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলের ভূমিকম্পে দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভারী বৃষ্টির মধ্যে রাতের বেলায় ভূমিকম্প আঘাত হানায় উদ্ধার অভিযান মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে।

ক্ষমতা দখল করে আফগানদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি তালেবান। বরং তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। হাজারো মানুষের মৃত্যুর শোক ছাপিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কঠিন রূপ নিয়েছে। ২০০১ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ও পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে দুই দশক লড়াই করেছে তালেবান বিদ্রোহীরা। এই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যে আটকা পড়ে দেশটির বিশাল অঞ্চলের মানুষ।

এছাড়া আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে আশ্রয় নেয়া বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত গোলা বর্ষণ করছে প্রতিবেশী পাকিস্তান। আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টির মতো গোলায় বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে তাদের বসতবাড়ি। পাকিস্তানের হামলা ছাড়াও তালেবান ক্ষমতায় আসায় সেখানে উগ্রপন্থীরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। প্রায়ই সন্ত্রাসী হামলায় বড় ধরনের হতাহতের খবর আসছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ আফগানিস্তানের নিয়মিত ঘটনা। হরহামেশাই বন্যা আর শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। অনাবৃষ্টি ও তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ মানুষ। আর হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশের দেশটিতে প্রাণঘাতী ভূমিকম্প তাদের নিত্যজীবনের অংশ। কিন্তু এবারের দুর্যোগ সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।

আশরাফ গনি সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আফগানিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪৫ শতাংশ, আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ সরকারি বাজেটের আশি শতাংশ আসত বিদেশি সহায়তা থেকে। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর সব বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া দেশটির সাড়ে ৯০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ করে যুক্তরাষ্ট্র।

আর আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের তহবিল পাঠানোও বন্ধ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এতো বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা আরও কোনো দেশকে সইতে হয়নি। সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে এসেছে।

বহু বছর ধরে পুকুর খনন, তুলা ও শস্যক্ষেতে সেচের কাজ ও শহরের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করে আসছে আফগান দিনমজুররা। এতে তাদের আয় ছিল নিতান্তই কম—দিনে দুই ডলারের মতো। কিন্তু তা দিয়েই পরিবারের জন্য খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করতে পারতেন তারা। কিন্তু এখন শহরের চত্বরে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও কাজ মিলছে না। দুপুরের খাবারের জন্য রুটি কেনার অর্থও জুটছে না।

আবার তালেবানের আগেও আফগানিস্তানের অর্থনীতি খুব একটা ভালো ছিল না। প্রবৃদ্ধির ধীর গতি, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও মারাত্মক অনাবৃষ্টিতে অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে আমদানিনির্ভর মৌলিক খাদ্য, জ্বালানি ও শিল্পজাত পণ্য। তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশগুলো তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। এতে আফগানিস্তানের আমদানির মূল উৎসগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ায় ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

ব্যাংক ঋণ ও ডলারের ঘাটতির কারণে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ভেঙে পড়েছে। ব্যবসার খরচও বেড়েছে। মাসের পর মাস বেতন না-পাওয়া শুল্ক কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের কাছে বড় অংকের উৎকোচ দাবি করছেন। আফগানিস্তানে যখন সবকিছু চরম অস্থিরতায়, তখনই এই ভূমিকম্পের আঘাত।

আফগানিস্তানের দক্ষিণপূর্বের দুর্গম অঞ্চলে সহায়তা পাঠানোও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। সেখানকার বাসিন্দারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করায় তাদের বসতবাড়ি মাটি ও খড়কুটোতে তৈরি। ভূমিকম্পে পুরো অঞ্চলটি শেষ হয়ে গেছে। অসময়ের শীত, বৃষ্টি, দমকা হাওয়া ও তুষারের মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে রাত কাটাতে হচ্ছে।

ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি লেগেছে পাকতিকা প্রদেশে। সেখানকার গভর্নরের মুখপাত্র সানাউল্লাহ মাসুম বলেন, খাদ্য, তাঁবু, কম্বল ও স্বাস্থ্য সহায়তা আসছে বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা থেকে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নগণ্য। আমরা আরও বেশি সহায়তার জন্য মুখিয়ে আছি।

আফগানিস্তানে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তার বিষয়ক অফিসের প্রধান ইসাবেল মৌসার্ড কার্লসেন বলেন, তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। যারা এতদিন প্রচণ্ড ঠান্ডায় ভুগছিলেন, এবার গরম তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসেবার সংকটে আসছে দিনগুলোতে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে। একের পর এক সংকটে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে।

আবদুল হান্নান নামের ৭০ বছর বয়সী স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ায় আমরা যারপরনাই খুশি ছিলাম। কিন্তু এমন সর্বনাশা দুর্যোগ কখনোই আমরা প্রত্যাশা করিনি।’ দুর্গম অঞ্চলে ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ দেখলে যে কোনো মানুষের মন মর্মান্তিক বেদনায় ভরে উঠবে। যুদ্ধ শেষ হলেও আফগানদের জীবনে সহিংসতা ও দুর্দশা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলছে, রাতারাতি বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিন কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার আফগানিস্তানের অর্ধেক মানুষ খাদ্য অনিরাপত্তায় ভুগছে। তাদের জীবন হুমকিতে। শের মোহাম্মদ নামের এক আফগান বলেন, যুদ্ধের চেয়েও আমরা খারাপ অবস্থায় আছি। অর্থনীতি এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে, আমাদের ওপর বোমা না পড়লেও খাদ্যাভাবে দিনে দিনে আমরা মৃত্যুর দিকেই যাচ্ছি।

লেখক: সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *