মুমিনের বিশেষ গুণ আত্মমর্যাদাবোধ

মুমিনের বিশেষ গুণ আত্মমর্যাদাবোধ

ধর্ম

ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩ ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আত্মমর্যাদাবোধ এমন একটি নৈতিকগুণ, যা দ্বারা মানুষ নিজের সম্মান, মর্যাদা, শৌর্য এবং নিজের অবস্থাকে হেফাজত করতে পারে।

উঠা, বসা, চলাফেরা, খানা-পিনা, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা ও প্রসাধনী গ্রহণ করা মোট কথা সামাজিক জীবনের সব অবস্থায় মানুষকে স্বীয় মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার জন্য আত্মমর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতেই হয়। যার মধ্যে এ গুণাবলির চিহ্নমাত্র নেই, তার দৃষ্টি কখনো উচ্চ হতে পারে না। তার চিন্তা ও চেতনার উন্নতি হয় না। মানুষের নজরেও তার সম্মান বর্ধিত হয় না। তার কথার মূল্য দেওয়া হয় না।

ইসলামি শক্তি যখন দুর্বল ছিল মুনাফিকরা একদিকে মুসলমানদের প্রতি বন্ধুত্বের ভাব প্রদর্শন করত, অপরদিকে কাফিরদের জাহেলি শান-শওকত ও ইজ্জত-সম্মানের কারণে তাদের প্রতিও বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করেছিল। তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের খেয়ালের ধোঁকাবাজির হাকিকতকে এভাবে খুলে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে কি তারা তাদেরই নিকট সম্মান প্রত্যাশা করে? অথচ যাবতীয় সম্মান শুধু আল্লাহরই জন্য নিবেদিত।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত নং-১৩৯)।

এরপর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ কথাও বলেছেন, ‘যদি কেউ সম্মান প্রত্যাশা করে, তাহলে জেনে রাখা দরকার যে, যাবতীয় ইজ্জত-সম্মান মহান আল্লাহতায়ালার কাছেই প্রার্থনা করতে হবে। পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, কেউ সম্মান প্রত্যাশা করলে জেনে রাখুক, সব সম্মান আল্লাহরই জন্য। (সূরা আল-ফাতির, আয়াত নং-১০)। অপর আয়াতে কারিমায় ঘোষণা করা হয়েছে, হে আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করো আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত করো। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত নং-২৬)।

একবার কোনো এক যুদ্ধে মুনাফিকদের সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এ কথা বলেছিলেন, মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে মদিনার সম্মানিত ব্যক্তিরা নিকৃষ্ট লোকদের অর্থাৎ মুসলমানদের সেখান থেকে বের করে দেবে। এর প্রত্যুত্তরে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করলেন, তারা বলে, আমরা যদি মদিনায় প্রত্যাবর্তন করি, তবে সেখান থেকে সবল অবশ্যই দুর্বলকে বহিষ্কার করবে।

শক্তি তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদেরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না। (সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত নং-৮)। এ আয়াতে কারিমায় আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের ইমান ও বিশ্বাসের এমন এক সম্মান প্রদান করেছেন, যা কখনো ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। এ জন্য প্রত্যেক মুসলমানের শির সমুন্নত থাকা প্রয়োজন এবং ধর্মীয় আত্মমর্যাদাবোধ সর্বদাই তাদের অনুভব করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে তাদের উত্তম চরিত্রের নমুনা হয়ে পৃথিবীতে অবস্থান করতে হবে। রাসূলে কারিম (সা.)-এর মহতী শিক্ষার ফলে সাহাবায়ে কেরামদের মাঝে সত্যিকার আত্মমর্যাদাবোধের অনুভূতি সর্বদাই পরিপূর্ণ ছিল।

হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে রাসূলে কারিম (সা.) কর্তৃক মঞ্জুরকৃত শর্তাবলির ওপর হজরত ওমর (রা.) অসম্মতি জ্ঞাপন করার যে দুর্জয় সাহস প্রদর্শন করেছিলেন তা আত্মমর্যাদা সুলভ অনুভূতির কারণেই। একবার হজরত হাসান বিন আলী (রা.)কে জিজ্ঞেস করা হলো-মানুষ বলাবলি করে যে আপনি অহংকারী। জবাবে তিনি বললেন, অহংকার নয় বরং আত্মমর্যাদাবোধই আমার মধ্যে আছে।

এ আত্মমর্যাদাবোধ হচ্ছে মূল শরাফত ও আসল সম্মানের চাবিকাঠি। যার মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ নেই, সে মানুষের দৃষ্টিতে সম্মানের অধিকারী হতে পারে না। তবে এ জাতীয় নৈতিক আত্মমর্যাদা এবং সম্মানজনক অবস্থার হেফাজতের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে একটি কথার প্রতি অবশ্যই নজর রাখতে হবে যে, কথাবার্তা, চাল-চলন, লেবাস-পোশাক সব জিনিসেই কোনোক্রমেই যেন অহমিকা, হীনমন্যতা এবং লোক দেখানো মনোভাব উজ্জীবিত হতে না পারে। এমনকি এ জাতীয় মনোবৃত্তির গন্ধও যেন প্রকাশ না পায়।

এ প্রসঙ্গে একবার আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, যে ব্যক্তির অন্তরে অণু পরিমাণও অহংকার বিরাজ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমন সময় এক ব্যক্তি আরজ করল, আমি ভালো ও উত্তম পোশাক এবং উত্তম জুতা পছন্দ করি। এসব বস্তু কি অহংকারের মধ্যে গণ্য হবে? তিনি বললেন, আল্লাহ নিজেই সুন্দর এবং তিনি নিজেই সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার হচ্ছে সত্য ও যথার্থ অবস্থাকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে হেয় জ্ঞান করা। (জামে তিরমিজি)।

অভাব-অনটনের সময় সাধারণ মানুষের সাহায্য লাভের জন্য আবেদন-নিবেদন করাও আত্মসম্মান রক্ষার বিপরীত। ইসলাম এ ধরনের আবেদন-নিবেদনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনকে মানুষের সামনে পেশ করে তার প্রয়োজন ও অভাব দূর হয় না। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার সামনে নিজের প্রয়োজনকে পেশ করে অবশ্যই আল্লাহতায়ালা তার অভাব দূর করে দিতে পারেন। অকস্মাৎ সম্পদের অধিকারী করে কিংবা মৃত্যুদান করে।

উপর্যুক্ত বিশ্লেষণ দ্বারা এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, একজন মুসলমানের জন্য ইসলাম এবং ইমানের নেয়ামত ও ইজ্জত এমন একটি সম্পদ যার মোকাবিলায় যাবতীয় নেয়ামত এবং সম্পদ খুবই নগণ্য। যে ব্যক্তি সত্যিকার মুসলমান, সে আল্লাহতায়ালাকে ছাড়া কাউকে পরোয়া করে না, সে কারও সামনে অবনত হয় না, সে কারও সামনে হাত পাতে না এবং মুসলমান হিসাবে সে নিজের অবস্থানকে দুনিয়ার অন্যান্য বস্তু থেকে উচ্চ মনে করে।

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *