মরণোত্তর অঙ্গদান, ইসলাম কী বলে?

মরণোত্তর অঙ্গদান, ইসলাম কী বলে?

ধর্ম

ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩ ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞান তার স্বর্ণ শিখরে পদার্পণ করেছে। এখন এমন উপায়ে চিকিৎসা করা হয় যা পূর্বেকার যুগে কল্পনাও করা যেত না।

যেমন কারো কিডনি নষ্ট হয়ে গেল অথবা চক্ষুদৃষ্টি হারিয়ে ফেলল আরেকজন মৃত ব্যক্তি থেকে কিডনি অথবা চক্ষু স্থানান্তর করে তার মধ্যে প্রতিস্থাপন করে। এতে অসুস্থ লোকটি সুস্থতা লাভ করে।

প্রতিস্থাপিত চোখের মাধ্যমে মানুষ এখন দেখতে পায় এবং কিডনি সচল হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় মরণোত্তর অঙ্গদান বা ক্যাডাভারিক অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন।

উন্নত দেশগুলোতে মরণোত্তর অঙ্গদানের বিষয়টি বহুল প্রচলিত। আমাদের দেশেও ইদানীং কিছুটা হচ্ছে তবে ব্যাপক নয়।  যেমন কিছুদিন পূর্বে সারাহ ইসলাম নামের এক নারী মরণোত্তর তার কিডনি এবং চক্ষু দান করেছিল। এখন জানার বিষয় হলো- এভাবে মরণোত্তর অঙ্গদান ইসলামের দৃষ্টিতে কি জায়েজ?

ইসলাম একটি শাশ্বত ,সার্বজনীন, যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক ধর্ম। পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার সুস্পষ্ট নীতিমালা ও দিক- নির্দেশনা রয়েছে।

মানুষের সুস্থতা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা ও নীতিমালা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমরা  নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৫)

অন্যত্র বলেন, ‘আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করে।’ (সূরা মায়েদা ৩২)

হযরত উসামা (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক বেদুইন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি চিকিৎসা  গ্রহণ করব? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। কেননা আল্লাহ এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখেননি। সুতরাং যে তা জানল সে জানল। আর যে জানলো না সে জানলো না।  (মুসনাদে আহমদ; হাদিস নং ১৮৪৫৪)

এসব আয়াত এবং হাদিসের নির্দেশনা হলো- মানুষ তার সুস্থতা লাভের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে এবং তার সাধ্যের ভেতর যত ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয় তা অবলম্বন করবে এবং অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থতা লাভের জন্য অন্যরাও এগিয়ে আসবে, সব ধরনের সহযোগিতা করবে। যারা এরূপ করবে নিঃসন্দেহে তা মানব সেবা বলে গণ্য হবে। এবং তারা অশেষ নেকি লাভ করবে।

প্রশ্নের মূল উত্তর:

মরণোত্তর অঙ্গদানের বিষয়টি নিয়ে আলেমদের বেশ মতানৈক্য রয়েছে। পূর্বেকার যুগে চিকিৎসার এ পদ্ধতি ছিল না, বর্তমানে তা আবিষ্কৃত হয়েছে।  যেহেতু সরাসরি কুরআন-হাদিসে এ বিষয়ের স্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই তাই এ ব্যাপারে সমকালীন ও নিকট অতীতের ফুকাহায়ে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত  হয়।

সৌদি আরব, মিসর, কুয়েত জর্ডানসহ গোটা আরব বিশ্বের ওলামায়ে কেরাম বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা করেছেন এবং নির্দিষ্ট কিছু শর্তের ভিত্তিতে জায়েজ হওয়ার স্বপক্ষে ব্যক্তি মতামত দিয়েছেন এবং ফিকহী বোর্ড কেন্দ্রিক সম্মিলিত ফতোয়াও প্রকাশ করেছেন।

যেমন শায়খে আজহার জাদুল হক আলি জাদুল হক, সাইয়েদ মুহাম্মদ তানতাবী, ইউসুফ কারযাভী, মুস্তাফা জারকা, নাসের ফরিদ ওয়াসেল, আলী জুমআ, আতিয়া সকর, মুহাম্মদ নাঈম ইয়াসিন, ইকরামা সাবরি, আব্দুর রহমান ইবনে নাসির সাদী ও ইব্রাহিম দাহকুবীসহ বহু বিখ্যাত আরব ইসলামিক স্কলাররা বিষয়টি জায়েজ হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন।

১৯৮৮ সালে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী থেকে জায়েজ হওয়ার স্বপক্ষে সম্মিলিত ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে। এমনিভাবে সৌদি আরবের অন্যান্য ফিকহী বোর্ড, এবং মিসর, কুয়েত ও জর্দানের বিভিন্ন ফিকহী বোর্ড থেকেও সম্মিলিত ফতোয়া প্রকাশ করেছে।

১৯৬৯ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামিক কনফারেন্স থেকে ও জায়েজ হওয়ার ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে।

ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশ মুফতিয়ানে কেরাম নাজায়েজ হওয়ার ফতোয়াই প্রদান করেছেন। তবে কিছু সংখ্যক মুফতিয়ানে কেরাম যুগের চাহিদা, মানুষের প্রয়োজন এবং সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় জায়েজের ফতোয়া দিয়েছেন।

আমাদের বাংলাদেশের বিজ্ঞ মুফতি ও প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন (হাফিযাহুল্লাহু) তার অনবদ্য সংকলন ‘ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা’য় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং জায়েজ হওয়ার কথা বলেছেন।

উল্লেখ্য যে, যারা জায়েজ বলেছেন তারাও ব্যাপকভাবে নয় এবং সীমিত পরিসরে বিশেষ প্রয়োজনে নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে জায়েজের কথা বলেছেন। সাথে সাথে সাথে এ বিষয়েও কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন যে, এই ফতোয়াকে পুঁজি করে মানবাঙ্গের ক্রয়-বিক্রয়ে জড়িত হওয়া, একে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়া, মানব পাচার ও লাশ চুরির মতো জঘন্য ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়া সম্পূর্ণ হারাম হবে।

যে চক্র এ কাজে জড়িত হবে পরকালে তাদের মহান আল্লাহর দরবারে কঠিন জবাবদিহিতা করতে হবে। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।

যেসব শর্তে মরণোত্তর অঙ্গ ট্রান্সপ্লান্টেশন জায়েজ:

১.যথাসাধ্য চেষ্টা করবে, যেন মুসলমানের অঙ্গ মুসলমানদের শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়।

২. কোনো মুসলমানের অঙ্গ কোন কাফেরকে কিছুতেই দেওয়া যাবে না।

৩. অভিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য ডাক্তাররা এ কথা বলেন- রোগীর  অকেজো ও বিকল অঙ্গটির স্থানে অন্য কারোর সুস্থ অঙ্গ প্রতিস্থাপন ছাড়া তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

৪. যার জন্য অঙ্গটি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হচ্ছে, তার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে হবে যে, এর দ্বারা লোকটি সুস্থ হয়ে যাবে।

৫. যার থেকে অঙ্গটি ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে তার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। এক্ষেত্রে অন্তত তিনজন অভিজ্ঞ দ্বীনদার ডাক্তার তার ডেথ সার্টিফিকেট প্রদান করা।

৬. অঙ্গদানকারী মৃত্যুর পূর্বে সুস্থ থাকা অবস্থায় কোন প্রকারের বাধ্যবাধকতা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গদানের ওসিয়ত করা।

৭. মৃত্যুর পর অঙ্গ স্থানান্তরের  ব্যাপারে ওয়ারিশগণের পূর্ণ সমর্থন থাকা।

৮. ওসিয়তকৃত অঙ্গটি এমন না হওয়া যার দ্বারা বংশ পরিচিতি মিশ্রণ হয়ে যায়। যেমন পুরুষাঙ্গ কিংবা গর্ভাশয় দান করার ওসিয়ত করা।

৯.অঙ্গ ট্রান্সপ্ল্যান্টশন রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত ও নির্বাচিত অভিজ্ঞ ডাক্তারদের একটি টিমের তত্ত্বাবধানে হওয়া।

১০. কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন না হওয়া।

১১. যদি কোনো মৃত লাওয়ারিশ হয়, তাহলে তার অঙ্গ কিছুতেই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যাবে না ইত্যাদি।

সূত্র: (ফাতাওয়া উসমানী-৪/২২৩-২২৬) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা;১৬৩-১৭৪, ক্বারারাতু মাজাল্লাতি মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, জিদ্দা, সংখ্যা, ৪, খ.১, পৃ.৫০৭, ক্বারার নং (১) ৪/০৮/৮৮,পৃ.৯-১০)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *