ঢাকায় ডেরেক শোলের ব্যস্ত দিন

ঢাকায় ডেরেক শোলের ব্যস্ত দিন

জাতীয় স্লাইড

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩ ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র না থাকলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সীমিত হতে পারে-এমন মন্তব্য করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে। তিনি বলেন, গণতন্ত্র নিয়ে সুনির্দিষ্ট পথরেখা না দেওয়ায় জো বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ নেই। তার আশা-আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হবে। আর তা না হলে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকবে। এছাড়া টেকসই সংস্কার হলে র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠতে পারে বলেও জানান তিনি।

বুধবার ডেরেক শোলের ঢাকা সফরের শেষ আয়োজন ছিল গণমাধ্যমের কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে মতবিনিময়। সেখানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। মতবিনিময়কালে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ তুলে ধরেন ডেরেক শোলে। বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ঢাকাকে গুরুত্ব দিচ্ছে ওয়াশিংটন।

বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠলে মার্কিন এই শীর্ষ কূটনীতিক আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী নির্বাচন ভালো হবে। আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ সময় বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতন্ত্রচর্চার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তা না হলে সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে।

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অ্যান্টনি ব্লিংকেনের এই উপদেষ্টা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন টানাপোড়েনে বাংলাদেশকে কোনো পক্ষ নেওয়ার কথা বলবে না যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে তুরস্কের ভূমিকম্পসহ বিশ্বব্যাপী নানা মানবিক সংকট থাকলেও রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি তাদের গুরুত্ব কমবে না বলেও মন্তব্য করেন ডেরেক শোলে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ মিয়ানমারে নিহিত।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত না থাকার প্রশ্নে শোলে বলেন, আগামী দিনে শক্তিশালী গণতন্ত্র সম্মেলনে অংশগ্রহণের পথ সুগম করবে। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আগে ডেরেক শোলের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলটি প্রথমে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়ায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি।’ সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের একথা জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ‘খুব ভালো’ বৈঠক হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের উপদেষ্টা ডেরেক শোলে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে গুরুত্ব দেয়, সে কারণেই আমরা আজ এখানে। রাজনৈতিকভাবে, নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দুদেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ওপর আমরা কতটা গুরুত্ব দিই, এই সফর তারই প্রতীক। যৌথ ব্রিফিংয়ে ডেরেক শোলে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। দুদেশের এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী। এটা ৫১ বছরের শক্তিশালী অংশীদারত্ব এবং আগামী ৫১ বছর ও তার পরবর্তী সময়ের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি।

ডেরেক শোলের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন ব্রিফিংয়ে বলেন, উনি এসেছেন আমাদের দুদেশের সম্পর্ককে আরও ভালো করার জন্য, শক্তিশালী করার জন্য। গত ৫০ বছরে আমাদের সম্পর্ক ভালো। কিন্তু এই সম্পর্ক আমরা আরও সামনে নিয়ে যেতে চাই, সলিডিফাই করতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে বড় ইনভেস্টর। বাংলাদেশে নতুন গড়ে তোলা একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্যও যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানানোর কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের উপদেষ্টা ডেরেক শোলে।

তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা হিসাবে বাংলাদেশকে সহায়তার পাশাপাশি আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি এ সংকটের গোড়ার কারণ নিয়ে কাজ করতে, যা মিয়ানমারের ভেতরেই নিহিত। বুধবার ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর এক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

ডেরেক শোলে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-এ অঞ্চলে বাংলাদেশ যা করে যাচ্ছে, সেটা বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে। আমরা জানি, মিয়ানমারের ১০ লাখের বেশি শরণার্থীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। দুদিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন ব্লিংকেনের উপদেষ্টা ডেরেক শোলে। সকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তিনি।

দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে ডেরেক শোলের পৃথক বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন সংকট প্রাধান্য পায়। কাউন্সেলর শোলে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এ জনগোষ্ঠীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচারিক প্রক্রিয়ায় সমর্থন এবং সম্ভাব্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে রোহিঙ্গাদের জন্য অব্যাহত মানবিক সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানায় এবং ভাসানচরে তাদের চলমান মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার জন্য অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান এবং প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রের জোর সমর্থন ও সহায়তা কামনা করে।

আলোচনায় রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং অনতিবিলম্বে যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পক্ষে বাংলাদেশ তার জোরালো অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে। পালটাপালটি বাণিজ্য অবরোধের জেরে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট খাদ্য ও জালানি সংকট এবং জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে এর নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। খাদ্য সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে মর্মে শোলে অবহিত করেন। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত নিরসনে গৃহীতব্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সমর্থন পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।

মার্কিন প্রতিনিধি দল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) কার্যক্রমের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়ে সাধুবাদ জানিয়ে টেকসই সংস্কারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। র‌্যাবকে একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও কার্যকরী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা উল্লেখপূর্বক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এ সংস্থা ইতোমধ্যে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এ সময় তিনি র‌্যাবের দক্ষতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ও সহায়তা কামনা করেন। আর্থসামাজিক খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে নির্ধারিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের উদার বিনিয়োগ নীতির সুযোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানান। এছাড়া বৈঠকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সচিব (পশ্চিম) রাষ্ট্রদূত শাব্বির আহমদ চৌধুরী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, ইউএসএআইডি প্রশাসকের কাউন্সেলর ক্লিনটন হোয়াইট, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রিন্সিপাল ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, দক্ষিণ মধ্য এশিয়া ব্যুরো এলিজাবেথ হর্স্ট এবং অ্যাম্বাসেডর-অ্যাট-লার্জ ফর গ্লোবাল ক্রিমিনাল জাস্টিস বেথ ভ্যান শ্যাক যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *