ক্যানিবালিজম বাস্তবে মানুষখেকো গুহা

ক্যানিবালিজম বাস্তবে মানুষখেকো গুহা

ফিচার স্পেশাল

অক্টোবর ২২, ২০২২ ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বাস্তবে এমন অনেক আদিবাসী মানুষের গোষ্ঠী আছে, যারা ক্যানিবালিজমে বিশ্বাস করে। মানে অনেক পশুর মতো নিজের স্বজাতি মানুষদের মেরে তার মাংস খায়। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে পাপুয়া নিউগিনি দ্বীপে ঠিক এরকমই এক আদিম মানব গোষ্ঠীর বসবাস।

ইংল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিমে সোমারসেট অঞ্চলে গফের গুহার কথাও বলা যায় এই প্রসঙ্গে।  ১২,৫০০ বছর আগেকার মানুষের জমানো হাড়ের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে সেখানে। যেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন পুরাপ্রস্তর যুগের গোড়ার দিকে এখানে মানুষের মৃতদেহ নিয়ে নানা ধরনের পৈশাচিক কাজকর্ম হত।  ইতিহাসের পাতায় নজর দিলে এরকম আরো অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। কিন্তু তাই বলে গুহা? গুহা আবার মানুষখেকো হতে পারে? কিন্তু ঠিক এই অভাবনীয় বিষয়টিই সত্য হয়েছে। এই পৃথিবীর বুকে রয়েছে এমনই এক ভয়ংকর নরখাদক গুহা।

যে গুহার প্রবেশমুখে পা রাখলে, প্রাণে বেঁচে ফেরে না মানুষ। মানুষ হোক, বা পশু পাখি, একবার সে গুহায় ঢুকলে কারও নিস্তার নেই। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই গুহা থেকে জীবন্ত ফিরে আসা কার্যত অসম্ভব। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। মানুষখেকো এই ভয়ংকর গুহার অবস্থান তুরস্কের নেভশায়ার অঞ্চলে। এক সময় এই অঞ্চল গ্রিক সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।

প্রাচীন গ্রিকবাসীদের বিশ্বাস ছিল এই গুহার গোলকধাঁধার মধ্যেই লুকোনো আছে মৃত্যুর পর পরলোকে যাওয়ার পথ। জীবিত প্রাণের অপেক্ষায় গুহার অন্ধকারে ওঁত পেতে থাকেন অশরীরী অপদেবতারা। সাধারণ মানুষ বা জীব-জানোয়াররা সে পথে পা রাখলে তাদের পরিণতি কী হবে তা বলাই বাহুল্য।

গ্রিক পুরাণ আর ইতিহাস ঘেঁটে এই গুহার যে কাহিনি পাওয়া যায় তাও কম নৃশংস নয়। এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে রক্তলোলুপ এই গুহার গল্প। (Maneater Cave) আপাত নিরীহ প্রবেশপথ, যার আড়ালে ওঁত পেতে আছে মৃত্যুর দূত গ্রিক ভূগোলবিদ স্ট্রাবোর তাঁর পুঁথিতে ২০০০ বছর আগে এই গুহার কথা উল্লেখ করে যান।

প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এই অঞ্চলটিতে আগে হিয়েরাপলিস নামে এক শহর ছিল। রোমান দেবতা প্লুটোর এক জাগ্রত মন্দির ছিল সেই শহরে। রোমান  রাণমতে, প্লুটো পাতালপুরির সর্বোচ্চ দেবতা। মৃত্যুর দেবতাও তিনিই। সোজা কথায় তিনিই ছিলেন নরকের অধীশ্বর। যার গ্রীক নাম হেডিস।

ক্রোনোস ছিলেন অসম্ভব শক্তিশালী রাজা এবং টাইটানদের শাসনকর্তা। তিনি অত্যন্ত অত্যাচারীও ছিলেন। তার ছেলে জিউস তো রীতিমতো ঘৃণা করতেন বাবা ক্রোনোসকে। সে ঘৃণার কারণও ছিল। জিউসের জন্মের আগে তার পাঁচ ভাইবোনকে, মানে নিজের সন্তানদেরই গিলে খেয়েছিলেন ক্রোনোস। এও এক আশ্চর্য ক্যানিবালিজম। কিন্তু কেন এমন করেছিলেন তিনি? পুরাণ বলছে, এই নৃশংসতার মূলে আছে এক দৈববাণী। এই দৈববাণী থেকে ক্রোনাস জানতে পেরেছিলেন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে তারই ঔরসজাত সন্তান। পরে জিউসের নেতৃত্বে ভাইয়েরা দল বেঁধে বাবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে ক্রোনাস সহ অন্যান্য টাইটানদের পরাজয় ঘটে। দৈববাণী সফল হয়। গ্রীক ও রোমান পুরাণে এই ঘটনা টাইটানোমেশি বা টাইটানদের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

নিজের সন্তানদেরই গিলে খেয়েছিলেন ক্রোনোস  টাইটানদের পরাজিত করে জিউসের দলবল তাদের টারটারাস নামে অন্ধকার এক পাতাললোকে নিক্ষেপ করেন। টাইটানদের সঙ্গে যুদ্ধের পর জিউস তার দুই ভাই পসেইডন ও হেডিসের সঙ্গে বিশ্বচরাচর ভাগ করে নেন। জিউস হন আকাশের দেবতা, পসেইডন সমুদ্রের এবং হেডিস বা প্লুটো মৃতলোক বা পাতালের দেবতা হন। হিয়ারাপলিস শহরে এই পাতালের দেবতা প্লুটো পূজিত হতেন। প্লুটোর মন্দিরের পাশেই ছিল এক গুহা। বলা হত এই গুহার ভেতরেই নাকি লুকোনো আছে পাতালে প্রবেশ করার রাস্তা। প্লুটো ছিলেন সেই রক্তলোলুপ অন্ধকার গুহার অধীশ্বর। স্থানীয় বিশ্বাস ছিল এই যে গুহার ভেতরে পাতালপুরীর দেবতারা বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলতেন।

তাই ঐ গুহার ভেতরে ভুল করে কেউ ঢুকে পড়লেই তার মৃত্যু অনিবার্য। বাস্তবে হতও ঠিক তাই। কেউ একবার সাহস করে সে গুহায় ঢুকলে সে আর ফিরে আসত না। এই গুহা যে অভিশপ্ত, তা নিয়ে কারও মনেই আর সন্দেহ ছিল না।

গুহার ভেতরের পাতালপুরীর দেবতারা যাতে সাধারণ মানুষের উপর রুষ্ট না হন তাই স্থানীয় বাসিন্দারা দেবতাদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেওয়ার পরিকল্পনা করে। পালা করে প্রতিদিন কেউ না কেউ পোষা গরু, মহিষ, ছাগল নিয়ে গিয়ে সেই গুহার সামনে ছেড়ে আসত। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই গবাদি পশুরা গুহার ঢোকামাত্র প্রাণ হারাত। যেন হাজার বছরের খিদে নিয়ে কে বা কারা তাদের প্রাণরসটুকু একেবারে নিঃশেষে গিলে নিত। গুহার ভিতরে পড়ে থাকত শুধু হতভাগা প্রাণীগুলোর নির্জীব শরীর। উঁকি মেরে দেবতারা তাদের ভেট নিয়েছে এটুকু বোঝা মাত্র ঘরের পথ ধরত গ্রামের লোক। দ্বিতীয়বার পিছু ফিরে নরকের গুহার দিকে তাকানোর সাহস হত না তাদের।

কিন্তু অনেক সময় গবাদি পশুরা ওই গুহায় ঢুকতে চাইত না। দেবতার উদ্দেশ্যে পাঠানো ভেট তো আর ফেরত নেওয়া যায় না। তখন বাধ্য হয়েই অবলয়া জন্তুগুলোকে তাদের মালিক জোর করে গুহার ভেতর ঢুকিয়ে দিতে যেত। এর ফল হত নিদারুণ। গুহায় ঢোকামাত্র পোষ্যদের পাশাপাশি তাদের মালিকটিরও মৃত্যু হত তৎক্ষণাৎ। এরকম দুএকটা ঘটনার পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে ভীষণ ভয় ঢুকে যায়। এদিকে পশু বলি না দিলে দেবতা পাছে রুষ্ট হয়, সে আশঙ্কাও ছিল। তাই গ্রামবাসীদের হয়ে প্লুটোর স্মরণে পশু বলি দেওয়ার জন্য মন্দিরের যাজকদের ঠিক করা হয়। একটা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে যাজকরা এই কাজ করতেন। যে ধর্মগুরুদের তত্ত্বাবধানে এই কাজগুলো করা হত তারা পশু নিয়ে গুহার মধ্যে প্রবেশ করতেন এবং বলি দেওয়া শেষে অবিশ্বাস্যভাবে জীবিত বেরিয়ে আসতেন গুহা থেকে। প্রাণে বাঁচলেও, তারা যখন বেরিয়ে আসতেন তখন তাদের মুখ থাকত অসম্ভব ফোলা আর রক্তাক্ত। এসব দেখে শুনে পুরোহিতদের অসীম ক্ষমতার উপর অন্ধবিশ্বাস জন্মে যায় প্রাচীন গ্রিকবাসীদের। তারা বিশ্বাস করতেন কোনো এক ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে অপদেবতাদের সাথে লড়াই করে ফিরে আসতেন পুরোহিতরা। দৈবী ক্ষমতা না থাকায় যেটা বাকি সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল অসম্ভব। এইসব পুরোহিতদের ভগবান জ্ঞানে পুজো করাও হত। এই ঘটনার পর থেকে গ্রীক-রোমান যুগে একটি আইন করা হয়েছিল যে যাজক ছাড়া কেউ যদি এই গুহার আশেপাশে যায় তবে তাকে ভয়ংকর শাস্তির মুখে পরতে হবে।

এখন প্রশ্ন হল, এরকম মানুষখেকো গুহা থাকা কি সত্যিই সম্ভব? নাকি এই সব ভয়ংকর ঘটনার পেছনেও লুকোনো আছে কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। স্ট্রাবোর পুঁথির সূত্র ধরে বিষয়টি নিইয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন আমেরিকার নিউইয়র্ক কলেজের অধ্যাপক শেলডেন। এই বিষয়ে তিনি বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য নতুন তথ্য প্রকাশ করে চমকে দেন সবাইকে। প্রাচীন গ্রিক শহরটি বর্তমানে পশ্চিম তুর্কির পাযুক্কাল শহরে অবস্থিত। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে আছে প্রচুর উষ্ণ প্রস্রবণ। তার মধ্যে জমে আছে সম্ভব বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম কার্বনেট। অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে এ থেকে উৎপন্ন হয় প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস। শেলডেনের মতে, সেই বাষ্প এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড কোনও ফাটল দিয়ে ঢুকে যায় গুহার ভেতর। আমরা জানি সামান্য বেশি মাত্রায় কার্বন ডাই-অক্সাইড মানুষের শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। মাত্র ১০ শতাংশ কার্বনডাই-অক্সাইড যে কোনও প্রাণীর মৃত্যু ঘটাতে পারে মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে। সেখানে গুহার বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কত ছিল জানেন? প্রায় ৯১ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই কোনো প্রাণী বা মানুষ গুহার মুখে প্রবেশ করলে অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে ছটফট করে মারা যেত। ঐ গুহা ছিল আসলে বিষাক্ত বাতাসের চেম্বার। নরকের প্রবেশদ্বারই বটে!

তবে এখানেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। যে গুহা বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভর্তি, কোনও প্রাণীরই তো সেখানে বেঁচে থাকার কথা নয়। তাহলে যাজকরা ভিতরে ঢুকলে মারা যেত না কেন? এ ব্যাপারেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন শেলডেন। তাঁর মতে, যাজকরা বিষয়টা আগে থেকেই জানত, সেজন্য তারা এই গুহার ভিতরে ঢোকামাত্র দম বন্ধ করে ফেলত। এভাবে প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে কোনওক্রমে কাজটুকু শেষ করে ঐ মৃত্যুগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসত তারা। আর বাইরের পৃথিবীতে নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতার মহিমা প্রচার করে বেড়াত। তবে তারা যখন গুহার বাইরে আসতো তখন তাদের মুখ আর শরীরও বিষাক্ত গ্যাসের কুপ্রভাবে ফুলে যেত, জায়গায় জায়গায় জমাট বেঁধে যেত রক্ত। সাধারণ মানুষ ভাবত অপশক্তির সঙ্গে লড়ে বিধ্বস্ত হয়ে ফিরেছেন দৈবী ক্ষমতাসম্পন্ন পুরোহিতরা।

বর্তমান পশ্চিম তুর্কীতে মন্দিরের সংলগ্ন রহস্যময় গুহাটি আজও আছে। কয়েক বছর আগে একদল অস্ট্রেলীয় ছাত্র অনুসন্ধিৎসবশত ওই গুহার ভেতরে ঢুকেছিল পরীক্ষার জন্য। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এটাই যে, তারা আর ফিরে আসেনি। এরপর থেকে তুর্কি সরকার সেই গুহার মুখে লোহার পাত বসিয়ে দিয়েছে। যাতে কোনওভাবেই আর কেউ সেই মৃত্যুকূপের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *