আজ থেকে কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় শুরু হচ্ছে ০৩ দিনব্যাপী লালন মেলা

দেশজুড়ে

অক্টোবর ১৭, ২০২২ ৩:১৮ অপরাহ্ণ

মতিউর রহমান সরকার দুখু(প্রতিনিধি):

বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ এর ১৩২তম তিরোধান দিবস ২০২২ উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় লালন একাডেমি চত্বরে আজ থেকে লালন মেলা শুরু হচ্ছে।মেলাটি ১৭,১৮ ও ১৯ অক্টোবর,২০২২; ০১,০২ ও ০৩ কার্তিক,১৪২৯; সোম, মঙ্গল ও বুধবার ০৩( তিন) দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে। মেলার পাশাপাশি উক্ত দিনসমূহে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬:১৫টা থেকে লালন আলোচনা সভা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।লালন একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়া জেলা প্রসাশক জনাব মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে মেলাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” সাধক লালন শাহ এর বিখ্যাত উক্তিটি ছেউরিয়ার লালন মাজারের মূল ফটকে প্রবেশপথে চোখে পড়ে।লালন ফকির ছিলেন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক ।ফকির লালন সাঁই ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কারো মতে তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। আবার কারো কারো মতে তিনি যশোরে জন্মগ্ৰহণ করেন। লালন গড়াই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাড়ারা গ্রামের হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন শ্রী মাধব কর আর মা ছিলেন শ্রীমতি পদ্মাবতী। অল্প বয়সে বাবা মারা যাবার পর সংসারের হাল ধরার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ হয়ে ওঠেনি। মায়ের সেবার জন্য অল্প বয়সে তিনি বিয়ে করেন।লালন সাঁই এর সংগীতের প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। সেই অনুরাগ থেকে বিভিন্ন কবিগান, পালা গান ও কীর্তনে গান গেয়ে মানুষকে মুগ্ধ করতেন।

একবার লালন তরুণ বয়সে তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সতীর্থরা তাকে মৃত ভেবে কালীগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন একজন মুসলিম নারী।এরপর সে নারীর সেবা-শুশ্রূষায় লালন সুস্থ হয়ে উঠলেও গুটি বসন্তে তাঁর একটি চোখ অন্ধ হয়ে যায় এবং মুখমন্ডলে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সুস্থ হয়ে লালন মা এবং স্ত্রীর কাছে ফিরে যায়। তখনকার হিন্দু সমাজপতিরা এই বলে তাকে পরিত্যাগ করে যে, তাঁর ( লালন) অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং সে মুসলমানের হাতে অন্ন খেয়েছে। এ অপবাদে লালনকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। লালনের সাথে তাঁর স্ত্রী গৃহত্যাগী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু সমাজের শাসন,লোকচক্ষুর ভয়,ধর্মের বেড়াজাল তার সে পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। এই দু:খ যন্ত্রনা সইতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।

এরপর সমাজ বিচ্যুত লালনের মরমী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সাথে যোগাযোগ ঘটে । সিরাজ সাঁই ছিলেন কাহার সমপ্রদায়ের একজন সাধক পুরুষ। এই সাধকের সান্নিধ্যে এসে লালন দিনে দিনে হয়ে উঠেন আধ্যাত্বিক চিন্তা চেতনার প্রধান পুরুষ।গুরু সিরাজ সাঁই এর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া করেন।তিনি জাত,ধর্ম,বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর গানে মানবধর্মের কথা বলে গেছেন। তিনি বলেন,

“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে,
লালন কয় জাতের কী রূপ
দেখলাম না এই নজরে।”

এছাড়া তিনি বলেন,

“কেউ মালা, কেউ তসবি গলায়
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জেতের চিহ্ন রয় কার রে।”

এভাবেই গানে গানে তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন।লালন কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তবে সব ধর্মের মানুষের সাথে তাঁর ছিল ভাল সম্পর্ক।

২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের মধ্যে ১২ তম স্থানে আসেন সাধক লালন সাঁই। এভাবে যুগে যুগে মানুষের মনে জায়গা করে নেয়া ফকির লালন সাঁই ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (১২৯৭ সালের ১ কার্তিক) ইহলোক ত্যাগ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *